বাংলাদেশে প্রকৃতির আশীর্বাদ

বাংলাদেশের গর্ব হচ্ছে- এর নদ-নদী, যা বিশ্বের বৃহত্তম নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে একটি। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীসহ বদ্বীপের এ দেশে প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। নদীর তীরবর্তী প্রকৃতি এদেশের মানুষের জীবনধারা, রীতিনীতি, অর্থনীতি ও ইতিহাসে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি ২০ ডিগ্রি ৩৪’ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ২৬ ডিগ্রি ৩৩’ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রি ০১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ৯২ ডিগ্রি ৪১’ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের দেশটির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তজুড়ে রয়েছে ভারত। এ ছাড়া দক্ষিণ-পূর্বের ছোট একটি অংশে মিয়ানমারের সাথে এদেশের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি আর্দ্র নিম্ন জলাভূমি অঞ্চল এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মওসুমি বায়ু দ্বারা এ দেশের জলবায়ু বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। বর্ষাকালে এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে দেশের অনেক নিম্ন অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশে সাংবাৎসরিক প্রাকৃতিক ঘটনা। দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ভূখণ্ডকে জলাভূমি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। সে জন্য এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের ভূখণ্ড জলাভূমি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।

জলাভূমি বিশ্বের অন্যতম জীববৈচিত্র্যময় বাস্তুতন্ত্র; যা পরিবেশগত, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সেবা প্রদান করে এবং বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণ প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির আবাস ভূমির ব্যবস্থা করে থাকে।

এই অনন্য বাস্তুতন্ত্র শত শত জলজ উদ্ভিদ, মাছ, পাখি এবং অন্যান্য প্রাণীর আবাসন। এ ছাড়া এসব জলাভূমি হাজার হাজার অতিথি পাখির আবাসস্থল শীতকালীন এবং গ্রামের মানুষের আয় ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যদিও জাতির মূলে রয়েছে এসব জলাভূমি, তবে এগুলো এখন মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের কারণে হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে জলবিদ্যুৎ এবং বাস্তুসংস্থানের ভিত্তিতে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। সারা দেশে কৃষি ও শিল্প উন্নয়নের কারণে এরই মধ্যে বিপুল পরিমাণে জলাভূমি হ্রাস পেয়েছে। এ জন্য সঠিকভাবে টেকসই জলাভূমি সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

বাংলাদেশ জলাভূমি সম্মেলনে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। বদ্বীপবিশিষ্ট দেশটিতে ‘আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি’ (রামসার সাইট) হিসেবে দু’টি স্থান মনোনীত হয়েছে- সুন্দরবনের সংরক্ষিত বন এবং সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, যা ৬,১১,২০০ হেক্টর অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। ১৯৭১ সালে জলাভূমিসংক্রান্ত রামসার সম্মেলনে স্বাক্ষর গ্রহণের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ২ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’ উদযাপিত হয়ে আসছে, যা বিশ্বের জলাভূমি সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। ‘বিশ্বজলাভূমি দিবস ২০১৯’-এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘জলাভূমি ও জলবায়ু পরিবর্তন’।

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রভাবে জলাভূমি অঞ্চলে প্রতিক্রিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার অভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, জলাভূমি অঞ্চলের ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করার জন্য আরো গবেষণার প্রয়োজন। মনুষ্যসৃষ্ট কার্যকলাপে বিশ্বব্যাপী জলাভূমিগুলোর অব্যাহত ক্ষতি চিহ্নিত করা দরকার। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কৃষি ও উন্নয়নের জন্য অধিকতর ব্যবহার এবং পলিমাটি জমাসহ বিভিন্ন ধরনের হুমকির কারণে জলাভূমির পরিমাণ ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। জলাভূমির বিজ্ঞ ব্যবহার, এর মান নিশ্চিত করা এবং জলাভূমি হ্রাসের কারণ ও প্রভাব চিহ্নিত করার পাশাপাশি বর্তমান জলাভূমি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে জলাভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি পৃথকভাবে সংযোজন করা হয় না। মানুষের চাহিদা ও জলাভূমি সংরক্ষণের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশে সম্প্রদায়ভিত্তিক জলাভূমির ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে জলাভূমি হ্রাস প্রতিরোধে এটি যথেষ্ট নয়। সেজন্য জলাভূমির আরো হ্রাস বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগতভাবে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা উচিত। ভূমি ও পানি ব্যবহারের সমন্বিত পদ্ধতিতে এবং প্রকৃতপক্ষে দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় জলাভূমি ব্যবস্থাপনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। দেশের জলাভূমিগুলোর টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য নীতি, কৌশল ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা পরিবেশগত ও আর্থসামাজিক কার্যক্রম ও প্রক্রিয়ার জ্ঞান এবং বোঝার ওপর ভিত্তি করে অবশ্যই গৃহীত হওয়া উচিত।

লেখক : ইউএনবি ও ঢাকাকুরিয়ারের এডিটর ইন চিফ এবং ওয়াইল্ড টিমের চেয়ারম্যান

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top