বলিউড কাঁপানো অভিনেত্রী জয়া বচ্চনের আদি নিবাস নেত্রকোনায়!

Joya-Bacchanএকসময় বলিউড কাঁপানো জয়া বচ্চন এবং অমিতাভ বচ্চন দুজনকে কে না চেনে? অথচ এই জয়া বচ্চনের আদি নিবাস ময়মনসিংহের নেত্রকোনায়! শুনে অবাক হচ্ছেন! অবাক হওয়ারই কথা। বিশ্বের নানান দেশে এমন বিখ্যাত মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেনা যাদের শিকড় গেথে আছে এই বাংলাদেশে। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ এর কথা যাদের মনে আছে, তাদের নিশ্চয় ১৫ বছর বয়সের ছোট্ট মেয়েটির কথা স্মরণে আছে। যিনি একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অনিল চ্যাটার্জি ও মাধবি মূখার্জি সঙ্গে। সেইদিনের সেই ‘জয়া ভাদুরি’-ই আজকের ‘জয়া বচ্চন’। ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিংবদন্তি অভিনেত্রী তিনি এবং বলিউড শাহেন শাহ অমিতাভ বচ্চনের পত্নি! অভিনয় আর মানবিক গুণ দিয়ে গোটা ভারত বর্ষ জয় করেছেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নেই তার কোনো বিতর্ক। আর সেই খ্যাতিমান নায়িকার আদি নিবাস নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলায়। ১৯৪৭-৪৮ সালের দেশ বিভাগের পূর্বে তার বাবা তরুণ কুমার ভাদুরী কলকাতায় চলে যান। জয়া বচ্চন শুধু অভিনেত্রীেই নন, একজন রাজনীতিবিদও।

ছোট থেকেই জেদি স্বভাবের জয়া যখন যা চাইতেন, তাই অর্জন করেই তবে শান্ত হতেন। খেলাধুলোয় বিশেষ আগ্রহ ছিল জয়ার। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তবে তার আগে তিনি সত্যজিৎ রায়ের সেই ‘মহানগর’ ছবিতে কাজ করে ফেলেন। ১৯৬৬ সালে সারা ভারত সেরা এনসিসি ক্যাডেট সম্মানে সম্মানিত হন জয়া।

জয়া ১৫ বছর বয়সে সত্যজিৎ রায়ের বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র মহানগর (১৯৬৩) চলচ্চিত্রে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। এতে শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় ও মাধবী মুখোপাধ্যায়। এরপর তিনি আরও দুটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, সেগুলো হল ১৩ মিনিট দৈর্ঘ্যের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সুমন এবং ১৯৭১ সালে ধন্যি মেয়ে চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের শ্যালিকা চরিত্রে।

সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি পুনের ভারতীয় চলচ্চিত্র ও দূরদর্শন সংস্থানে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সেখানে অভিনয় বিষয়ে অধ্যয়ন করেন এবং স্বর্ণপদক সহ স্নাতক সম্পন্ন করেন। এই সময়ে হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় তাকে গুড্ডি (১৯৭১) চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় কাজের জন্য নির্বাচন করেন। এতে তাকে ধর্মেন্দ্রর প্রতি মোহাগ্রস্থ স্কুল বালিকার চরিত্রে দেখা যায়। গুড্ডি চলচ্চিত্রটি সফলতা লাভ করে, এবং তিনি বম্বে চলে যান ও আরও কাজের প্রস্তাব পেতে থাকেন। ১৪ বছর বয়সী স্কুল বালিকা চরিত্রে তার অভিনয় তাকে এই ধরনের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে এবং তাকে পরবর্তী কালেও এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। তিনি পরিচালক গুলজার, বাসু চ্যাটার্জী ও হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলিতে সৌহার্দপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করে সফলতা অর্জন করেন।

তিনি উপহার (১৯৭১) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। এরপর পিয়া কা ঘর (১৯৭২), পরিচয় (১৯৭২), কোশিশ (১৯৭২) ও বাবর্চি (১৯৭২) চলচ্চিত্রগুলিতে তার অভিনয়কে অনুভূতিপ্রবণ বলে বিবেচনা করা হয়।[৭][৯] ততদিনে তিনি জনপ্রিয় তারকা হয়ে ওঠেন।[৬] গুলজারের কোশিশ চলচ্চিত্রে তিনি ও সঞ্জীব কুমার শ্রবণ প্রতিবন্ধী দম্পতি চরিত্রে অভিনয় করেন, যারা তাদের প্রতিবন্ধী হিসেবে বিভিন্ন দুর্ভোগের সম্মুখীন হন। তিনি এই চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতাকে তার ভবিষ্যৎ জীবনে সামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে অনুপ্রেরণা বলে উল্লেখ করেন। যদিও তিনি জওয়ানি দিওয়ানি (১৯৭২) চলচ্চিত্রে আড়ম্বরপূর্ণ চরিত্রে, এবং অনামিকা (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করে এই ভাবমূর্তি থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি মূলত মধ্যবিত্ত ভাবানুভূতি নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলিতে অভিনয় করে সমাদৃত হন।

১৯৭২ সালে তিনি প্রথমবারের মত তার ভবিষ্যৎ স্বামী অমিতাভ বচ্চনের বিপরীতে বংশী বিরজু (১৯৭২) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। একই বছর তিনি বি. আর. ইশারার এক নজর চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অমিতাভ কয়েকটি চলচ্চিত্রে ব্যর্থ হওয়ার পর যখন অধিকাংশ প্রধান অভিনেত্রী তার সাথে সেলিম-জাভেদ রচিত জঞ্জির (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, জয়া তখন এই চলচ্চিত্রের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। চলচ্চিত্রটি ব্যবসা সফল হয় এবং অমিতাভের রাগী যুবক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে। এরপর তারা অভিমান (১৯৭৩), চুপকে চুপকে (১৯৭৫) ও শোলে (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে একসাথে অভিনয় করেন। অভিমান চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। পরের বছর তিনি কোরা কাগজ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে টানা দ্বিতীয়বারের মত শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন।

জয়া ও অমিতাভ শোলে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সময় তাদের কন্যা শ্বেতার জন্ম হয়। এরপর তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পরিমাণ কমিয়ে দেন এবং সন্তান লালনপালনে মনযোগী হয়ে ওঠেন। ১৯৭৯ সালে তিনি নৌকর চলচ্চিত্রে গীতা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য তার তৃতীয় শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। প্রধান অভিনেত্রী হিসেবে তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ছিল তার স্বামী অমিতাভের বিপরীতে সিলসিলা (১৯৮১)। তিনি শাহেনশাহ (১৯৮৮) চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখেন, এতে তার স্বামী প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।

দীর্ঘ বিরতির পর তিনি গোবিন্দ নিহলানির নকশাল আন্দোলন নিয়ে নির্মিত হাজার চৌরাশি কা মা (১৯৯৮) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০০ সালে তিনি ফিজা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন। পরের বছর তিনি করণ জোহরের তারকাসমৃদ্ধ পারিবারিক নাট্যধর্মী কভি খুশি কভি গম… (২০০১) চলচ্চিত্রে তার স্বামীর সাথে অভিনয় করেন। এই কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর তিনি করণ জোহরের পরবর্তী চলচ্চিত্র কাল হো না হো (২০০৩)-এ প্রীতি জিন্টার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে পুনরায় শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি তার পুত্র অভিষেক বচ্চনের সাথে লাগা চুনারি মেঁ দাগ (২০০৭) ও দ্রোণা (২০০৮) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

২০১১ সালে তিনি বাংলাদেশী চলচ্চিত্র মেহেরজান-এ নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। এটি ১৯৭১ বাংলাদেশে গণহত্যার সময়ে বাংলাদেশী তরুণী মেহের ও একজন পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার ভালোবাসার গল্প, যেখানে সেই কর্মকর্তাটি যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পাকিস্তানি সেনাদলের নিকট থেকে মেহেরকে রক্ষা করে। ২০১৬ সালে কারিনা কাপুর ও অর্জুন কাপুর অভিনীত কি অ্যান্ড কা (২০১৬) চলচ্চিত্রে তিনি ও অমিতাভ বচ্চন বিশেষ দৃশ্যে অভিনয় করেন।

জয়া বচ্চন শুধু অভিনেত্রীই নন। জয়া ২০০৪ সালে প্রথম সমাজবাদী পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয় এবং ২০০৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত রাজ্যসভায় উত্তর প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৬ সালের জুন মাসে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন, ২০১০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এই পদে বহাল থাকেন। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমর সিংকে সমাজবাদী পার্টির প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি তার মেয়াদ পূর্ণ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন এবং বলেন যে কেবল মুলায়েল সিং তাকে অব্যহতির কথা বললেই তিনি অব্যহতি দিবেন। ২০১২ সালে তিনি তৃতীয় মেয়াদে এবং ২০১৮ সালে চতুর্থ মেয়াদে পুনর্নির্বাচিত হন।

উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে জয়া বলিউড অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। অমিতাভ-জয়া দম্পতির শ্বেতা আর অভিষেক নামের দুই সন্তান হয়। বর্তমানে বাবা মার মত অভিষেকও বলিউডে সুনামের সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছেন। আবার অভিনেত্রী ও সাবকে বিশ্বসুন্দরীর আসন অর্জন করা ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন হলেন অভিষেক বচ্চনের স্ত্রী। সব মিলিয়ে নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ তথা বাংলাদেশের সাথে বচ্চন পরিবারের রয়েছে আত্নিক সম্পর্ক। বচ্চন পরিবার মুম্বইয়ের জুহুতে জলসা বাংলোয় বসবাস করেন। অসাধারণ অভিনয়ের জন্যে জয়া তার তিনবার ফিল্মফেয়ার-এ সেরা অভিনেত্রীর শিরোপা পেয়েছেন। ২০০৭ পেয়েছেন লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট-এর সম্মান। তার বাবার নাম তরুনকুমার বাদুড়ী, মা ইন্দিরা ভাদুড়ী।

জয়া বচ্চনের বাবা তরুনকুমার ভাদুড়ী ১৯৯৬ সালে মারা যান। তিনি একজন বাঙালি সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক ছিলেন। চম্বল এলাকার ডাকাতদের ওপর দুঃসাহসিক ও রোমাঞ্চকর তথ্য বই আকারে সাড়া জাগিয়েছিল। তিনি নাগপুর টাইমসের প্রধান সাংবাদিক ছিলেন। পরে ৬০ দশকের মধ্যভাগে দ্য স্টেটসম্যান সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হন। মূলত চম্বলের দস্যুদের ওপর রোমাঞ্চকর রিপোর্ট তৈরি করতেন। তিনি অভিযাত্রী প্রতিবেদক হিসেবে তাদের সাথে দেখাও করতেন। ইংরেজি, উর্দু হিন্দি ও বাংলা এই চারটি ভাষাতে সমান দক্ষতা ছিল তার।

Share this post

scroll to top