প্রেমের বিয়ের বিচ্ছেদে এগিয়ে নারীরা

> ২০২০ সালে মোট বিয়ের ৪৫ শতাংশই তালাক
>> তালাকে এগিয়ে নারীরা
>> ‘নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপোষ করছেন না’

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলছে করোনা মহামারি। তারপরও করোনার এই সময়ে (২০২০ সাল) দিনাজপুরে বিবাহবিচ্ছেদের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে গেছে বিগত বছরের রেকর্ডকে। জেলায় গতবছর তালাক হয়েছে মোট বিয়ের ৪৫ শতাংশ। আর বিচ্ছেদের জন্য নারীরাই পুরুষদের চেয়ে বেশি আবেদন করেছেন। আবার এসব নারীদের মধ্যে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর সংখ্যাই বেশি।

দিনাজপুর পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, দিনাজপুর পৌরসভায় তালাক-সংক্রান্ত সালিশি পরিষদে বৈঠক বসে মাসে দুইবার। সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছে গত ১ মার্চ। সেদিন ৪০টি তালাক-সংক্রান্ত বৈঠক ডাকা হয়। এই ৪০টি বিয়ের বেশিরভাগই ছিল প্রেমঘটিত। কারো বিয়ে হয়েছে পরিবারের সম্মতিতে, আবার কেউ কেউ বিয়ে করেন গোপনে। মেয়েদের চাপাচাপিতেই পরিবারের অজান্তে বিয়ে করে বসেন তারা। একপর্যায়ে পরিবারের সদস্যরা এসব বিয়ে মেনে নেন। তালাক দেয়া দম্পতিদের তালিকায় ছিলেন চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ সদস্যসহ সাধারণ দম্পতিরা।

ওইদিন যে ৪০টি তালাক-সংক্রান্ত বৈঠক হয়েছিল, তারমধ্যে ২৭টি তালাকই ছিল মেয়ে পক্ষের দেয়া। যা জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছে দিনাজপুর পৌরসভার তালাক সংক্রান্ত সালিশি পরিষদ।

শুধু চিকিৎসক, আইনজীবী বা পুলিশ নয়, এমন ভালোবাসার সংসার প্রতিনিয়িত ভেঙে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আগের চেয়ে কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজ করার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীরা সামাজিকতা ও লোকলজ্জার চেয়ে এখন নিজের আত্মসম্মানকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দিনাজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বদিউজ্জামান বাদল  বলেন, ‘স্টার জলসা, জিটিভি, স্টার প্লাসসহ আকাশ সংস্কৃতিও এরজন্য দায়ী। মাদকাসক্ত, ইন্টানেটের ব্যবহার সর্বোপরি যৌতুকের কুফল পড়ছে সংসারে। আর তাই সংসারে অশান্তি নিয়ে থাকার পরিবর্তে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তই বেশি নিচ্ছেন মেয়েরা।’

দিনাজপুর পৌরসভার তালাক-সংক্রান্ত সালিশি পরিষদ সূত্র জানায়, দিনাজপুরে ২০২০ সালে করোনা মহামারির মধ্যেও বিবাহবিচ্ছেদের হার আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলায় গতবছর তালাক হয়েছে মোট বিয়ের ৪৫ শতাংশ। আর বিচ্ছেদের জন্য নারীরাই পুরুষদের চেয়ে বেশি আবেদন করেছেন। আবার এসব নারীদের মধ্যে শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর সংখ্যাই বেশি।

দেশে প্রচলিত তালাকবিধি অনুযায়ী, তালাক দেয়ার পর কাজি অফিস থেকে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে চিঠি পাঠানো হয়। তালাকের পর পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ৯০ দিন সময় পায় সালিশ করে তালাকের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পন্ন করার।

সেই নিয়ম অনুযায়ী দিনাজপুর পৌরসভার তালাক-সংক্রান্ত সালিশি পরিষদে সালিশ চলাকালে মাসে দুইদিন ৪০-৪৫টি তালাক-সংক্রান্ত নথি উপস্থাপন করা হয়। যার মধ্যে প্রতি সালিশেই কোনো না কোনো তালাক চূড়ান্ত হয়। অনেক সময় তালাক ঠেকাতে ইচ্ছে করেই সময়ক্ষেপণ করা হয়। বেশ কয়েকবার সালিশের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়।

জেলা রেজিস্ট্রার অফিস সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর জেলায় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিয়ে হয়েছে ১২ হাজার ২৬৭টি, তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৩০টি। শতকরা হিসেবে যা ৪৫ শতাংশ। এরমধ্যে স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক দেয়া হয়েছে ৯৭৭টি, যা মোট তালাকের ৮ শতাংশ। আর স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক দেয়া হয়েছে দুই হাজার ২১৩টি, যা মোট তালাকের ১৮ শতাংশ। আর স্বামী-স্ত্রী উভয়ই তালাক দিয়েছেন দুই হাজার ৩৪০ জন, যা মোট তালাকের ১৯ শতাংশ।

২০১৯ সালে বিয়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৬৮৮টি, আর তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ৬৭৬টি। যা শতকরা ৩৬ শতাংশ প্রায়। ২০১৮ সালে বিয়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৫৫৯টি, আর তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ২০৮টি। যা শতকার ৩৩ শতাংশ প্রায়। ২০১৭ সালে বিয়ে হয়েছে ১৪ হাজার ২৬৪টি। এরমধ্যে তালাক হয়েছে পাঁচ হাজার ৩৪৫টি। যা শতকরা ৩৭ দশমিক ৪৭ ভাগ।

দিনাজপুর পৌরসভার তালাক-সংক্রান্ত সালিশি পরিষদের প্রধান প্যানেল মেয়র আবু তৈয়ব আলী দুলাল জানান, নারীদের তালাক দেয়ার হার পুরুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। পেশাগত উন্নয়ন, আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আগের চেয়ে বেশি সচেতন। নারীরা লোকলজ্জার ভয়ে এখন আর আপোষ করছেন না। বরং অশান্তি এড়াতে বিচ্ছেদের আবেদন করছেন।

চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) অ্যাডভোকেট মিন্টু কুমার পাল  বলেন, ‘সামাজিক জটিলতার জন্য সমাজে বিচ্ছেদের ঘটনা এক দশকে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সন্তানের মঙ্গল, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ রোধে বিচ্ছেদে যেতে নেতিবাচক কিছু নেই।’

তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকায় একজন নারী এখন তার পরিবারকেও আর্থিক সহায়তা করতে পারছেন। পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে অনেক নারী নিজের পেশা জীবনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। আর মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ফলে নারী নিজেই এখন বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তবে একমাত্র ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা ও মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী।

Share this post

scroll to top