প্রেমঘটিত দ্বন্দ্বের বলি ছাত্রলীগ নেতা

রাজধানীর বনানীতে ছাত্রলীগের ওয়ার্ড সভাপতি রাকিব হত্যার নেপথ্যে প্রেমঘটিত দ্বন্দ¦ বলে ধারণা করছে পরিবার ও তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

জানা গেছে, রাকিব বনানী থানার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি পরিবারের সাথে কড়াইল টিঅ্যান্ডটি কলোনির ৫ নম্বর রোডের ৪০৬ নম্বর বাসায় থাকতেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে বাসার পাশেই তাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় গতকাল সজিব ও জসিমের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের বাবা আলতাফ হোসেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আসামি সজিবের স্ত্রীর নাম তাহমিনা আক্তার মিম। ২০১৫ সালে পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের আগ থেকে মিমের সাথে নিহত রাকিবের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বিয়ের পরও রাকিবের সাথে সে সম্পর্ক চালিয়ে যান মিম। পরে এ নিয়ে সজিব-মিম-রাবিকের সাথে একাধিকবার ঝগড়া-বিবাদ-কলহ হয়েছে। একাধিক সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) হয়েছে।
এই বিষয়টি অনেকেই জানত। কিন্তু কিছুতেই কোনো সমাধান হচ্ছিল না। কুলকিনারা করতে না পেরে এবং প্রেমের সম্পর্ক ধরে রাখতে চলতি বছরের জুনে মিম সজিবকে তালাক দেয়। সজিব মিমকে একাধিকবার বুঝিয়ে ফেরাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মিম সজিবের ঘরে আর ফেরেনি। এতে সজিব ধারণা করেন রাকিবের কারণেই মিম কথা শুনছে না। এরই সূত্র ধরে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।

বনানী থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) সাইহান ওলিউল্লাহ জানান, পূর্বশত্রুতার জের ধরে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে আহত নুরুল ইসলামের কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তা যাছাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সাথে জড়িতদের ধরতে অভিযান চলছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার এসআই আবু তাহের ভূঁইয়া জানান, প্রেমঘটিত কারণে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। নিহতের বাবা আলতাফ হোসেন টিঅ্যান্ডটির লাইনম্যান। গত ১৭-১৮ বছরে ধরে তারা কড়াইল টিঅ্যান্ডটি কলোনির ওই বাসায় থাকছেন।

জানা গেছে, দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে রাকিব দ্বিতীয়। রাকিবের বড় ভাই তারেক হোসেন রনি একটি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিতে চাকরি করেন। দু’মাস আগে তিনি বিয়ে করেন। রাকিবের ছোট বোন দোলন স্থানীয় একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছে। আর রাবিক সরকারি তিতুমীর কলেজে এমবিএ ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের বিমানবন্দর থানার চন্দ্রপাড়ায়।
কত মানুষ, কত পুলিশ, কত সাংবাদিক আসছে; কিন্তু আমাদের রাকিব আসে না কেন বলে আহাজারি করছিলেন নিহতের খালা মাহমুদা খানম। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, কী অন্যায় করেছিল রাকিব যে, তাকে মারতে হবে। এত রাতে এসে এভাবে কুপিয়ে হত্যা করবে। এই হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।

নিহতের বেশ কয়েকজন বন্ধু জানান, ৮ ডিসেম্বর রাকিবের জন্মদিন ছিল। এ উপলক্ষে এক সপ্তাহ ধরে প্লান করে অনুষ্ঠান সাজাচ্ছিলেন তারা। বন্ধুদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করেন। কিন্তু জন্মদিন পালনের আগেই পরপারে চলে গেলেন রাকিব। তিনি ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন বলেও তারা জানিয়েছেন।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সুইপার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, রাকিবের বাসার পাশে একটি খালি জায়গায় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ঘটনার সময় তিনি পাশেই কাজ করছিলেন। আল আমিনের চিৎকার শুনে তিনি ঘটনাস্থলে দৌড়ে আসেন। আল আমিনের মুখে কোপের আঘাত দেখে তিনি তার গামছা দিয়ে আক্রান্তস্থান বেঁধে ফেলেন। পরক্ষণেই পাশের বিদ্যুৎখুঁটির কাছে গোঙানির শব্দ পান।

দেখেন, সেখানে রাকিব পড়ে আছে। তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। সে বলছে, মা আমাকে বাঁচাও, বাবা আমাকে বাঁচাও। পরে তিনি চিৎকার করলে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। তাকে দ্রুত উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাকিবকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থল অন্ধকার থাকায় তিনি কাউকে দেখতে পাননি।

গতকাল কড়াইল টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে গিয়ে দেখা গেছে, জুমার নামাজের আগে ঢামেক মর্গ থেকে ময়নাতদন্ত শেষে রাকিবের লাশ এলাকায় আনা হয়। পরে স্থানীয় জামিআ মুহাম্মাদিয়া ইসলামিয়া মসজিদে নামাজে জানাজার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মানুষের ঢল নামে। রাকিবের বাসায় গিয়ে দেখা যায়Ñ নিহতের স্বজন, সহকর্মী, সহপাঠী ও কড়াইল টিঅ্যান্ডটি কলোনির আশপাশের লোকজন আসছেন।
তারা নিহতের পরিবারের সদস্যদের শান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এ সময় অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। সেখানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আমগাছে ঘেরা টিনের ঘরে থাকতেন রাকিব। মসজিদ থেকে গলি ধরে কিছুটা পথ গেলেই রাকিবদের বাসা। তিনি তিনটি লাভবার্ড পালতেন। রাকিবের মৃত্যুতে পাখিগুলো যেন ছটফট করছিল। পরে তাদের অবমুক্ত করা হয়।

ঘটনাস্থল রাকিবের বাসা থেকে চার-পাঁচটি বাড়ির পর একটি ফাঁকা জায়গা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় তিনটি রাস্তার মিলনস্থল এটি। এখানেই দুর্বৃত্তরা আগ থেকে ওঁৎ পেতে ছিলেন। সেখানে বিদ্যুতের খুঁটির পাশে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। রক্তের উপর কিছু আগাছা রাখা হয়েছে। সেখানে স্থানীয়দের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। তারা ঘটনাস্থল দেখছেন আর হতাশা প্রকাশ করছিলেন।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top