‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় সালমান শাহকে’

বাংলা সিনেমার মহাতারকা সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি, বরং পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে দাবি তার মা নীলা চৌধুরীর। কয়েকটি সংস্থার তদন্তে সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা। সর্বশেষ মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত শেষে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে মর্মে ‘অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন’ দাখিল করেছে। সালমান শাহের মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ মানতে নারাজ পরিবার ও অগণিত ভক্ত। প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে আদালতে নাজারি দেবেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী।

১৯৯৬ সালের এ দিনে (৬ সেপ্টেম্বর) সালমান শাহের লাশ ১১/বি নিউ ইস্কাটন রোর্ডের স্কাটন প্লাজার বাসার নিজ কক্ষে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই সালমানকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করা হয়।

কয়েক দফা তদন্তে সালমান শাহর মৃত্যুকে ‘আত্মহত্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের শেষের দিকে তদন্তভার পিবিআইকে দেওয়া হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলার ‘অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন’ দাখিল করে পিবিআই। পিবিআইয়ের দেওয়া ২৮ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদনেও ‘৯টি কারণ’ দেখিয়ে সালমান শাহ’র মৃত্যুকে আত্মহত্যা উল্লেখ করা হয়। আগামী ১১ অক্টোবর ওই প্রতিবেদনের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী জানান, সালমান শাহ আত্মহত্যা করার মতো ছেলে ছিল না। এটিকে আত্মহত্যা বলা হলে তো মানুষ হাসবে। এটি নিছক আত্মহত্যা নয়, বরং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। অপরাধীদের স্বার্থ রক্ষার্থে এমন প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, যারা এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত তারা কেউ শান্তিতে নেই। দুনিয়াতে আল্লাহ তাদের শাস্তি দিচ্ছেন। শিগগিরই পিবিআইয়ের প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেওয়ার কথা জানান তিনি।

নীলা চৌধুরীর আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, পিবিআই যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। আমরা অনেক তথ্য-উপাত্ত ও আলামত আদালতে দিয়েছে। পিবিআই সেগুলো পর্যালোচনাই করেনি। মামলার এক আসামি রিজভী যার বিরুদ্ধে সাজা হয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে পুলিশ যাকে খুঁজে পাচ্ছে না। পিবিআই তাকে গ্রেপ্তার না করে তার জবানবন্দি নিয়েছে।

তিনি জানান, করোনাভাইরাসের কারণে সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী লন্ডন থেকে দেশে আসতে পারছেন না। তিনি দেশে এলেই প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে নারাজি দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মধ্যে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসা থেকে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের ওরফে সালমান শাহর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই সময় সালমানের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই সালমানকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করা হয়। অপমৃত্যুর মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন আদালত। তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। সেখানে সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়।

এরপর সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে রিভিশন মামলা করা হলে ২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠান আদালত। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তাধীন ছিল। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এ প্রতিবেদনেও সালমানের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ২০১৪ সালের ২১ ডিসেম্বর সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।

২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নারাজি আবেদন করেন। নারাজি আবেদনে আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ১১ জন সালমান শাহর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা বলা হয়। আদালত নারাজি আবেদনটি মঞ্জুর করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে (র্যাব) মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। এরপর মামলাটিতে র্যাবকে তদন্ত দেওয়ার আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করেন। ওই বছরের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর তৎকালীন বিচারক কে এম ইমরুল কায়েশ রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করে র্যাব মামলাটি আর তদন্ত করতে পারবে না বলে আদেশ দেন। এরপর ৭ ডিসেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিন ম্যাজিস্ট্রেট লস্কর সোহেল রানা মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে মামলার ‘অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন’ দাখিল করে পিবিআই। সেই প্রতিবেদনে সালমান শাহ’র সুইসাইডাল নোটের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুইসাইডাল নোটে বলা হয়, ‘আজকের পর যে কোনো দিন আমার মৃত্যু হলে তার জন্য কেউ দায়ী থাকবে না।’ প্রতিবেদনে বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু করে ৪৪ জন ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ও সালমান শাহ’র মামা আলমগীর কুমকুমসহ ১০ জনের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দির তথ্য রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সালের ১২ জুলাই চট্টগ্রামের এক ফ্যাশন শোতে সামিরার সঙ্গে পরিচয় হয় সালমান শাহ’র। ১৯৯১ সালের ১৮ আগস্ট সালমান শাহ তার বাবা-মার সঙ্গে সামিরাকে পরিচয় করিয়ে দেন। মা এ বিষয়ে সালমান শাহকে বকাবকি করলে সালমান আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এরপর ১৯৯২ সালের ২০ ডিসেম্বর সালমান শাহ গোপনে সামিরাকে বিয়ে করেন। নায়িকা শাবনূর তাদের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত করতো।

এছাড়া প্রতিবেদনে আত্মহত্যার কারণ শিরোনামে ৯টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো- ১. সালমান শাহ’র গলা বরাবর ঘাড়ে কোনো প্রকার দাগ ছিল না। শরীরেও কোনো আঘাত বা দাগের চিহ্ন নেই। ২. ময়না তদন্ত প্রতিবেদনেও সালমানের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা হয়েছে। ৩. প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টেও একই তথ্য দেওয়া হয়েছে। ৪. রাসায়নিক পরীক্ষাতেও আত্মহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ৫. মৃত্যুর আগে সালমান শাহ সুইসাইডাল নোট লিখে গেছেন। সেখানে তার মৃত্যুর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয় বলে বলেছেন। ৬. শাবনূরের সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা ছিল। আর পরিবার তা মেনে নেয়নি বলেই সালমান আত্মহত্যার পথ বেঁছে নেয়। ৭. ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে শাবনূরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে ঝগড়া হয়। এতে সালমান স্যাভলন খেয়ে আত্মহত্যা করতে চান। ৮. গালমান শাহের মায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। ৯. দাম্পত্য জীবন সালমান-সামিরার কোনো সন্তান ছিল না।

Share this post

scroll to top