পক্ষপাতিত্বের দায়ে ভারতে তোপের মুখে ফেসবুক, পার্লামেন্টে তলব

ভারতে ফেসবুক কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাত দেখাচ্ছে এবং ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় সহায়তা করছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, সেজন্যে ফেসবুকের শীর্ষ নির্বাহীদের বুধবার এক পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে এসে তার জবাবদিহি করতে হচ্ছে।

ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ঘৃণা এবং বিদ্বেষমূলক প্রচারণার বিষয়ে ফেসবুকের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে গেলেও ফেসবুক বিজেপির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।

তবে ভারতে ফেসবুকের বিরুদ্ধে বিজেপি পাল্টা অভিযোগ করে বলছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধ পক্ষের প্রতি ফেসবুক পক্ষপাত দেখাচ্ছে।

ফেসবুক দুই তরফ থেকে আসা অভিযোগই অস্বীকার করেছে।

এই অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মধ্যে পড়ে ভারতে ফেসবুক বেশ বিপাকে আছে । ভারতে ফেসবুকের ব্যবহারকারী প্রায় ৩০ কোটি। তাদের মালিকানাধীন হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারী আরো বেশি, ৪০ কোটি। কাজেই বলা যেতে পারে এই সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানির জন্য ভারত হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার।

ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগের কথা প্রথম ফাঁস হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে। তবে ফেসবুক দাবি করছে, তারা তাদের প্ল্যাটফর্মে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারের কোন সুযোগ দেয় না।

এক ইমেইলে ফেসবুক এ প্রসঙ্গে জানিয়েছে, “যে ধরণের কথা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ায় বা সহিংসতায় উস্কানি দেয়, আমরা সেসব কথা নিষিদ্ধ করেছি। আমাদের এই নীতি কার্যকর আছে গোটা বিশ্বেই। কার কি রাজনৈতিক অবস্থান বা কোন দলের সঙ্গে সম্পর্ক, সেগুলো বিবেচনা না করেই আমরা এই নীতি প্রয়োগ করি।”

কিন্তু ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক অনুসন্ধানী রিপোর্টের পর ভারতে ফেসবুকের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। এই বিতর্কের পটভূমিতেই আজ পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ফেসবুকের নির্বাহীদের তলব করা হয়েছে। ভারতে ফেসবুকের ‘হেড অব বিজনেস’ অজিত মোহান আজ ৩০ সদস্যের পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে হাজির হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

এই কমিটিতে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের এমপিরাই আছেন। তবে এটির প্রধান হচ্ছেন বিরোধী দল কংগ্রেসের একজন স্পষ্টভাষী এমপি শশী থারুর।

পার্লামেন্টারি কমিটির শুনানি হবে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সেখানে ‘নাগরিকদের অধিকারের সুরক্ষা’ এবং ‘সোশ্যাল/অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের’ ব্যাপারে ফেসবুকের নীতি নিয়ে কথাবার্তা হবে।

ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ঠিক কী?
ফেসবুকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে তারা ভারতে মুসলিম বিরোধী প্রচারণা তাদের প্লাটফর্মে চালিয়ে যেতে দিচ্ছে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ফেসবুকে এই কাজ বিজেপির প্রতি একধরণের পক্ষপাত।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, বিজেপির একজন নেতা, যিনি আইন সভার সদস্য, তিনি কিছু মুসলিম বিরোধী পোস্ট দিয়েছিলেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এ বিষয়ে ফেসবুকের কাছে জানতে চাইলে ফেসবুক সেসব পোস্ট ডিলিট করে দেয়।

এই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছিল, বিজেপি সমর্থক আরো অন্তত তিন ব্যক্তি একই ধরণের পোস্ট দেয়। এগুলো ছিল ফেসবুকের ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা’ বিষয়ক নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, এবং বিষয়টি ফেসবুকের নজরেও আনা হয়। অথচ তারপরও এসব পোস্ট ডিলিট করা হয়নি।

এই পুরো বিতর্কের কেন্দ্রে আছে ভারতে ফেসবুকের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আঁখি দাস। তিনি ভারতে ফেসবুকের পাবলিক পলিসি বিষয়ক একজন শীর্ষ নির্বাহী। আঁখি দাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনিই এসব পোস্ট ডিলিট না করার সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী, আঁখি দাস তার কর্মীদের বলেছিলেন, “মোদির দলের লোকজনের বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নিলে ভারতে ফেসবুকের ব্যবসার সম্ভাবনার ক্ষতি হবে।”

আঁখি দাসের ব্যাপারে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত সপ্তাহান্তে আরেকটি রিপোর্ট ছেপেছে। এই রিপোর্টে অভিযোগ করা হচ্ছে, তিনি ফেসবুকের কিছু আভ্যন্তরীণ বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দলকে সমর্থন করেছেন, একই সঙ্গে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাপূর্ণ কথা বলেছেন।

ফেসবুক অবশ্য জোর গলায় কোন দলের প্রতি পক্ষপাত দেখানোর কথা অস্বীকার করে চলেছে। তারা বলছে, আঁখি দাসের এসব কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে এনে ভুল অর্থ করা হচ্ছে।

ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই তদন্তের ফল কী হতে পারে
সংসদীয় কমিটির এই শুনানির ফল কী দাঁড়াবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ফেসবুকের মতো আন্তর্জাতিক সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্যাপারে ভারতীয় আইন খুব সুস্পষ্ট নয়। কাজেই কোন ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হবে না।

অন্যদিকে ভারতীয় নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের প্রভাব ক্রমশই বাড়ছে। এটি বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফেসবুক এবং বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপ ভারতীয় রাজনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন দল, তাদের এমপি বা রাজ্য আইন সভার সদস্য বা উঠতি রাজনৈতিক নেতা- সবাই ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। তারা জনমত তৈরি করা বা ভোটারদের সমর্থন আদায়ের কাজে এসব প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগান।

তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে ভারতে ফেসবুকের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তাদের সুনামে ক্ষতি করেছে। কারণ এরকম অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠছে আরো অনেক দেশে। ভারতে ফেসবুকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সেখানে তাদের বাজার সম্প্রসারণের পথে সমস্যা তৈরি করতে পারে। ভারত তাদের জন্য এক বিরাট বাজার।

এর আগে ফেসবুকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তারা ভুয়া খবর এবং গুজব বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভারতে গণপিটুনিতে হত্যার অনেক ঘটনার পেছনে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে দেয়া গুজবকে দায়ী করা হয়।

ফেসবুক একবার ভারতে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার এক পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু এ নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয় এই বলে যে, এর ফলে ‘নেট নিউট্রালিটি’ অর্থাৎ ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকার যে নীতি, সেটি লঙ্ঘিত হবে। এরপর সরকার এই পরিকল্পনায় বাধা দেয়।

ফেসবুক নিয়ে বিতর্কে রাজনৈতিক দলগুলো কী বলছে?
ভারতের তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী রবি শংকর প্রসাদত মঙ্গলবার ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মার্ক জাকারবার্গের কাছে একটি চিঠি লিখেছেন। এতে তিনি অভিযোগ করেছেন যে, ফেসবুকের কর্মীরা প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং তার মন্ত্রিসভার সিনিয়র মন্ত্রীদের সম্পর্কে বাজে কথা বলছেন।

তিনি আরো বলেছেন, তিনি এমন কথা জানতে পেরেছেন যে ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে বিজেপি যাতে বেশি লোকের কাছে পৌঁছাতে না পারে তার জন্য ফেসবুক সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিয়েছিল।

তবে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও মার্ক জাকারবার্গের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। তারা বলেছে, “ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা যেসব মূল্যবোধ আর অধিকারের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, ফেসবুক সেসব ব্যাহত করছে।

কংগ্রেস এরপর দ্বিতীয় আরেকটি চিঠি দিয়েছে ফেসবুককে। এটিতে তারা বলেছে, “একটি বিদেশি কোম্পানি যেন ভারতে সামাজিক বিভেদ তৈরি করতে না পারে”, সেজন্যে তারা আইন সভায় এবং আদালতে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বিবেচনা করছে। বিবিসি

Share this post

scroll to top