নিজেকে ”স্যার” বলতে বাধ্য করতেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক

কখনো কোথাও শিক্ষকতা করেননি। ছাত্রজীবনে টিউশনি করেছেন কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। তবুও তিনি স্যার। তিনি রাজনীতিসহ সমকালীন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। কবিতাও লিখেন মাঝে মধ্যে। সে জন্য তাকে সবাই স্যার বলে সম্বোধন করতে বাধ্য। তিনি সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী।
যুবলীগের নেতাকর্মীরা জানান, সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে গত কমিটি পর্যন্ত কোনো চেয়ারম্যানকেই ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করেনি কেউ। রাজনৈতিক সংস্কৃতি হিসেবে স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেক নেতাকর্মীই দলীয় প্রধানকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ‘আপা’ বলে সম্বোধন করেন সর্বস্তরের নেতাকর্মী। কিন্তু ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর যুবলীগের রাজনৈতিক সেই সংস্কৃতি পাল্টে যায়। সংগঠনের প্রত্যেকটি স্তরে নিজেকে ‘স্যার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। কেউ ‘স্যার’ না বলে ‘ভাই’ সম্বোধন করলেই তার ওপর চরম ক্ষিপ্ত হতেন তিনি। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে কোণঠাসা করে রাখতেন ওমর ফারুক চৌধুরী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনের চারজন প্রেসিডিয়াম সদস্য এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় নেতারা তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন শুরু করলে তিনি অকথ্য ভাষায় তাদের গালিগালাজ শুরু করেন। তিনি দলীয় চেয়ারম্যান। সে জন্য তাকে ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধন করার বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপরও চাপিয়ে দেন। কেউ ভুলে ‘ভাই’ বলে ডাকলে খড়গ নেমে আসত।’

দুইজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, ‘ওমর ফারুক চৌধুরীর বর্তমান বয়স ৭০ পার হলেও তার সমবয়সী কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। কিন্তু সিনিয়র সেই নেতারা তাকে ‘ভাই’ না বলে ‘স্যার’ সম্বোধন করতে বাধ্য হয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে ভেতরে ভেতরে দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ থাকলেও ওমর ফারুক চৌধুরীর ভয়ে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের মধ্যেও কানাঘুষা চলত।’

কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, নিজিকে ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধন করার যৌক্তিকতা মাঝে মধ্যে নিজেই তুলে ধরতেন ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি বলতেন, ‘আমি সৃষ্টিশীল মানুষ। রাজনীতি নিয়ে নানা গবেষণা করি। তোমাদেরকে রাজনীতি শিখাই আমি। আমি তোমাদের শিক্ষক। সে জন্য স্যার বলতে হবে।’

কমিটি বাণিজ্য ও ক্যাসিনোকাণ্ডে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া যুবলীগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন সিনিয়র নেতারা। গণভবনে রোববারের বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, যুবলীগের আসন্ন সপ্তম জাতীয় কংগ্রেস নিয়ে ডাকা এই বৈঠকে ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানা বক্তব্য দেন অধিকাংশ নেতা। তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘উনি আমাদের সাথে ঠিকভাবে কথাই বলেন না। বাসায় গেলে অথবা অফিসে দেখা হলেও দুর্ব্যবহার করতেন। অধিকাংশ সময় আমাদের সাথে অশোভন, অশালীন ও অরাজনৈতিক আচরণ করতেন। এ ক্ষেত্রে সিনিয়র নেতাদেরও ছাড় দিতেন না তিনি। অপমানের লজ্জা আর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তাকে সবাই ভয় পেত।’

বৈঠকে দুইজন নেতা ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ তোলে বলেন, ‘জেলা থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত উনি (ওমর ফারুক চৌধুরী) ইচ্ছেমতো কমিটি দিতেন। তিনি যাকে ইচ্ছা বহিষ্কার করতেন আবার যাকে ইচ্ছা পদ দিতেন। কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করতেন না।’
সূত্র জানায়, ওমর ফারুক চৌধুরীর রানিংমেট সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদও তার বক্তব্যে দলীয় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন করেন।
কেন্দ্রীয় নেতাদের এসব অভিযোগ শুনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি জানি বলেই তো ব্যবস্থা নিচ্ছি। এটা এখন নতুন করে কেন বলছো? আগে তো কেউ বলোনি।’ জবাবে দুইজন নেতা বলেন, ‘নেত্রী, আমরা সাহস ও সুযোগ কোনোটাই পাইনি।’

এ সময় শেখ হাসিনা আবার বলেন, ‘আগে বললে বুঝতাম সাহস করে বলেছো। তোমরা কি কাদেরকে (ওবায়দুল কাদের) বলেছো? বা অন্য কোনো সিনিয়র নেতাকে বলেছো? ঠিক আছে তার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেয়াই হলো। এখন এইসব বাদ দাও। ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মেলনটা করো, সংগঠন শক্তিশালী হবে, সুশৃঙ্খল হবে। বিতর্কিত কাউকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে রাখা যাবে না।’

Share this post

scroll to top