নাম বিড়ম্বনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন : বিভ্রান্তীতে দেশের মানুষ

Human-Rights-Bangladeshসারা দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো ভুয়া মানবাধিকার সংগঠন গড়ে উঠেছে বলে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে উদ্ধেগ জানিয়েছিলেন তৎকালীন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। শুধু তাই নয় ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ ও ‘বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট কমিশন’ নামের দুইটি সংগঠনের কারণে বাইরের বিভিন্ন দেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিতে পড়ে বলেও জানিয়েছিলেন মিজানুর রহমান। হঠাত্ করে কেউ নাম শুনলে মনে করবে এ সংগঠন দুটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকার কমিশন নিয়ে বিভ্রান্তি হওয়ায় সম্প্রতি কমিশনের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এসব কথিত সংগঠনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলেও তিনি অভিযোগ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের।

নাম নিয়ে বিভ্রান্তি নিরসনের তাগিদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনকৃত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ এর নাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। নামের সাদৃশ্যের কারণে সৃষ্ট বিভ্রান্তি নিরসনে এনজিওটির নাম থেকে কমিশন শব্দটি বদল বা প্রতিস্থাপনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারীতে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সঙ্গে এক বৈঠকে এই অনুরোধ জানান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। সিনিয়র তথ্য অফিসার মোঃ শাহ আলম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মঙ্গলবার সমাজকল্যাণমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এই বৈঠকে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের নাম নিয়ে আপত্তি ছাড়াও আরও দুইটি সমস্যা সমাধানে মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।

বৈঠকে দেশের পিতামাতার নামপরিচয়হীন শিশুদের বৈধকাগজপত্রে অভিভাবকত্ব নির্ণয়, মেয়ে বা ছেলের প্রবণতাসম্পন্ন হিজড়াদের লিঙ্গভিত্তিক নাম পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আলোচনা হয় বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এ সময় মন্ত্রী তাদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে আশ্বাস দেন এবং দেশের দুস্থ, প্রতিবন্ধী, হিজড়া এবং পরিচয়হীন শিশুদের স্বার্থে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল রিসার্চ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (অ্যালার্ট) নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে মানবাধিকার–বিষয়ক গোলটেবিল আলোচনায় মিজানুর রহমান এসব কথা বলেছিলেন।

এদিকে বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে এসব কথিত সংগঠনের বিভিন্ন নেতিবাচক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও বিভ্রান্তি ও সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। পাড়া-মহল্লা, অলিগলিতে মানবাধিকার সংগঠনের ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব ভুঁইফোড় এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুণ্ন হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাবমূর্তি। নামসর্বস্ব কথিত মানবাধিকার সংগঠনগুলো লব্ধ প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে নিজেদের নাম রাখছে, যাতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এসব সংগঠনের মানবাধিকার ‘বাণিজ্য’ এখন বেশ জমজমাট।

ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা সংগঠনগুলো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপপ্রচার চালানোর মাধ্যমে বিদেশি অর্থ আদায় থেকে শুরু করে থানা ও আদালতে তদবিরের মাধ্যমে অপরাধী ছাড়ানোর মতো কাজেও লিপ্ত। এমনকি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নির্যাতিতদের আইনি সহায়তা দেওয়ার নামেও সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে তারা। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে দ্রুত বাদী-বিবাদীর কাছে পৌঁছে যান কথিত এসব সংগঠনের তদন্ত কর্মকর্তারা। তার পর সালিশ-বৈঠক ও সমঝোতা করে দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা।

জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে মানবাধিকার সংগঠনের শাখা অফিস তৈরি করে এবং মানবাধিকারকর্মীর পরিচয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কথিত এসব মানবাধিকার সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদে সর্বজনগ্রহণযোগ্য বিচারপতি, উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নাম রেখে প্রতারণা করা হচ্ছে। দেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার সংগঠক ও বিচারপতিদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধনাঢ্য ব্যক্তি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকেও মাসোয়ারা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অন্তত একশ’র বেশি কথিত মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠন শ্রমিকদের ইস্যুতে বিদেশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও গার্মেন্ট মালিকদের সঙ্গে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে নানা সুযোগ-সুবিধা লুটে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণাকারী শতাধিক মানবাধিকার সংগঠন চিহ্নিত করেছে এনজিও ব্যুরো। শিগগিরই এসব সংগঠনের নিবন্ধন বাতিলসহ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মস দপ্তর।

জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মস দপ্তরের রেজিস্ট্রার বিজন কুমার বৈশ্য বলেন, নিবন্ধন নেওয়ার শর্ত অনেক শিথিল থাকায় সহজেই প্রতারকরা নিবন্ধন পেয়ে যায়। ভালো ভালো কথা ও শর্ত পূরণ করায় নিবন্ধন পেয়ে তারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। আমরা অনেক সংগঠনের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছি। দেশের জাতীয় ও প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠনের সুনাম পুঁজি করে তারা প্রতারণা করছে। তবে আমার মাত্র দু’জন ইন্সপেক্টর আছে। বিশেষ করে, এদের নিবন্ধন দিতে অনেক বড় জায়গা থেকে তদবির থাকে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয় না।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংগঠনের নামের সঙ্গে মিল রেখে প্রতারণার জাল ছড়ানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও রাস্তার পাশে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে নানা চটকদার সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে ‘বিবাহ, তালাক, যৌতুক, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, পারিবারিক বিরোধ, জমি নিয়ে ঝামেলা, দেনমোহরসহ গরিব-অসহায়দের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা’ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলা হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও আইনি সহায়তার নামে প্রতারণা করা হয়। অনেকে নামের মারপ্যাঁচের ঘোরে পড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হয়ে মানবাধিকারের সুরক্ষা পাওয়া দূরে থাক, উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

এনজিও ব্যুরো, সমাজসেবা, সমবায়, সমাজকল্যাণ, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মসের দপ্তর থেকে সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে নিবন্ধন নিয়ে মানবাধিকারের নামে প্রতারণা করা হচ্ছে। প্রতারক চক্রের একটি বড় অংশ বিভিন্ন অখ্যাত আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ডধারী সাংবাদিক। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো একই ধরনের বা কাছাকাছি নাম রয়েছে বেশ কয়েকটি সংগঠনের। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ডেভেলপমেন্ট কমিশন ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও বাংলাদেশ মানবাধিকার জাতীয় কমিশন নামে একাধিক বেসরকারি সংস্থা রয়েছে। হঠাৎ করে কেউ নাম শুনলে মনে করবে, এ সংগঠনগুলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতো সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকার কমিশন নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ায় সম্প্রতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে পত্রিকায় সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সচিব এম এ সালাম বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নাম ব্যবহার করে কিছু অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার ব্যক্তিদের আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানি এবং প্রতারিত করছে। এসব অসাধু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিজেদের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি পরিচয় দিয়ে জনগণকে প্রতারিত করছে। এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। গত মাসে এমন দুটি ভুঁইফোড় সংগঠনের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, আসকের নামের সঙ্গে মিল রেখেও প্রতারণা করছে কয়েকটি চক্র। অসহায় মানুষ, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে। নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ ও আদালত এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে মানবাধিকার নিয়ে যাচ্ছেতাই হবে। এদের কারণে প্রায়ই বিব্রত হতে হচ্ছে আমাদের।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেও প্রতারণা করা হচ্ছে; নেওয়া হচ্ছে পুলিশের কাছ থেকে মাসোয়ারা। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় তার প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের একই নামে সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে চক্রটি প্রতারণা করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের লাগাম টেনে ধরার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

এক হাজার টাকা করে কার্ড বিক্রি ও সালিশ-বৈঠকের নামে উভয় পক্ষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয় ন্যাশনাল প্রেস সোসাইটি নামে রাজধানীর একটি মানবাধিকার সংগঠন। সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে নিবন্ধন নেওয়া এ সংগঠনের আইডি কার্ডের ওপরে বড় করে লেখা রয়েছে ‘গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থা’। গভ. রেজি. এস-৭০০৬(১৯৪)/০৭, অফিস-১২৭/এ মতিঝিল সি/এ, ঢাকা। মিরপুর ১১ নম্বরের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা আজাহারুল ইসলামের কাছ থেকে লিগ্যাল নোটিশ করে অফিসে এনে নারী নির্যাতন ও তালাক মামলার মীমাংসার জন্য ৫০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছয় মাসেও কোনো সমঝোতা করতে না পেরে উল্টো আরও দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। আজাহারুল ইসলাম এ বিষয়ে মিরপুর থানায় মামলা পর্যন্ত করেছেন।

পত্রিকায় নারী ও শিশু নির্যাতন, মামলা, পরিবেশদূষণ, খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি ও ভূমি-সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হলে সেগুলোর কাটিং সংগ্রহ করে উভয় পক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠায় ‘ঢাকা মানবাধিকার কমিশন’, যার রেজি. নম্বর ৪০৪৯৫(২৪৩৬)২০০০, ৬৬/এ মানিকনগর মডেল স্কুল রোড, ঢাকা-১২০৩। এ সংগঠনের প্রধান কার্যালয় লালবাগে। মগবাজার, মহাখালী, মিরপুর, ফার্মগেট ও যাত্রাবাড়ীতে রয়েছে আঞ্চলিক অফিস। এ সংগঠনের চেয়ারম্যান আলী আহমেদ ও মহাসচিব হিসেবে রয়েছে শাইখ সিরাজীর নাম। একাধিক ভুয়া বিচারপতি ও আর্মি অফিসারের নামও রয়েছে। সংগঠনের পরিচালক (তদন্ত) অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দীন মুন্সী বলেন, ‘আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকি। অনেক ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের রিপোর্ট দেখেও আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে আইনি উদ্যোগ নিই। আবেদনের জন্য খরচ হিসেবে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। আমাদের শাখা অফিস নিতে ২০ হাজার টাকা ও মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচয়পত্র নিতে পাঁচ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়।’ এ সংগঠনের পক্ষ থেকে কয়েকটি মনগড়া অভিযোগ উত্থাপন করে গত সোমবার ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লায়ন এম কে বাশারকেও লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

একজন ভুক্তভোগী হিসেবে মিরপুরের তালতলার পেট্রোল পাম্পের পাশের গলির ‘বাংলাদেশি মানবাধিকার কমিশন’ অফিসের পরিচালক আফজাল হোসেন খানের মোবাইলে (০১৭১১-৪৫৫৯৭৫) ফোন দিলে তিনি জানান, দুই হাজার টাকায় তাদের কার্ড পাওয়া যাবে। কমিশনের পরিচয়পত্র থাকলে মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকার ট্রাফিক পুলিশ ধরবে না। এ কার্ড দিয়ে থানা ও সচিবালয়ে প্রবেশ করা যাবে।

মালিবাগ, মৌচাক, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, মহাখালী, বাড্ডা, গুলিস্তান, পুরানা পল্টন, লালবাগ, বিজয়নগর, রাজারবাগ, টঙ্গী, বনানী, ফার্মগেট এলাকায় এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের প্রধান কার্যালয় রয়েছে। হিউম্যান ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ও শুধু ‘মানবাধিকার’ নাম দিয়ে মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ‘এ’ ব্লকে অফিস খুলে প্রতারণার অভিযোগ আছে। মিরপুর থেকে মতিঝিলে চলাচলকারী বিভিন্ন বাসের গায়ে এ দুটি সংগঠনের লিফলেট ও স্টিকার দেখা গেছে। মিরপুরে গার্মেন্ট শ্রমিক, বিহারি ক্যাম্প থেকে শুরু করে সাধারণ পারিবারিক বহু বিরোধের ঘটনায় সালিশের নামে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এসব সংগঠনের নামে। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন (বিএইচসি)_ এ প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হচ্ছে মালিবাগের ২২২/ক, ঢাকা-১২১৭। এ প্রতিষ্ঠানের নামে দেশজুড়ে প্রতারণা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনের নামে প্রতারণার অভিযোগে তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠন ‘ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ক্রাইম রিপোর্টার্স ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান এস এম হুমায়ুন কবীরসহ তিনজনকে আটক করেছিল পুলিশ। এ সংগঠনও ঢাকাসহ সারাদেশে টাকার বিনিময়ে আইডি কার্ড বিক্রি করে আসছিল। মানবাধিকার সংগঠনের নামে প্রেস লেখা আইডি কার্ড বিক্রি করাই এ সংগঠনের মূল কাজ। সারাদেশে তাদের প্রায় ১৫ হাজার সদস্যকে সাংবাদিক লেখা পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে বলে সংগঠনটির কর্মকর্তারা জানান। জেল থেকে বের হওয়ার পর এই চক্র আবারও একই ধরনের প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নামের সঙ্গে মিল রেখে একাধিক মানবাধিকার সংগঠন গড়ে তুলে প্রতারণা করায় একটি চক্রের কয়েকজনকে আটক করে র‌্যাব। মানবাধিকারের নামে প্রতারণা, অর্থ আত্মসাৎ ও মানসিক নির্যাতনকারীদের বিষয়ে র‌্যাবের সহায়তা নিতে তিনি সবাইকে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দেশের স্বনামধন্য মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নামের সঙ্গে কিছুটা মিল রেখে বাংলাদেশ আইন সহায়তা কেন্দ্র (বাআসক) ও জাতীয় আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশন নামে দুটি সংস্থার পৃথক নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের অষ্টম তলায় অফিস খুলে সারাদেশে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। বাআসকের প্যাডের ওপরে লেখা রয়েছে_ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ (ইউএন) তালিকাভুক্ত, গভ. রেজি. সোসাইটি অ্যাক্ট-৯৪১৭, রেজি. (অবজারভার) বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন-৮১।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস সোসাইটি, সামাজিক পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, জাতীয় মানবাধিকার সোসাইটি ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সোসাইটি, বাংলাদেশ পরিবেশ ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি, কনজ্যুমার অ্যান্ড প্যাসেঞ্জার রাইটস প্রোটেক্ট সোসাইটি, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস জার্নালিস্ট অ্যান্ড কালচারাল সোসাইটি নামে মানবাধিকার সংগঠনগুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে মানবাধিকার কর্মকর্তা নিয়োগ দিচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি দেওয়া হচ্ছে। এসব সংগঠন সালিশ-বৈঠক ছাড়াও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে থাকে।

সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে প্রতারণা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে এমন মানবাধিকার সংগঠনের মধ্যে রয়েছে_ ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট সোসাইটি, জাগো হিউম্যান রাইটস সোসাইটি, বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সোসাইটি, সাংবাদিক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ মানবাধিকার সোসাইটি, গ্রিন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সোসাইটি, বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস সোসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ক্রাইম সোসাইটি, ওয়ার্ল্ড হিউম্যান রাইটস ক্রাইম রিপোর্টার্স সোসাইটি, বাংলাদেশ প্রেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংস্থা, ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডিটেক্টিভ নিউজ সোসাইটি, জার্নালিস্ট সোসাইটি ফর হিউম্যান রাইটস ও মানবাধিকার ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। অভিযোগ রয়েছে, এই সংগঠনগুলোর প্রধান কাজই হচ্ছে সদস্য সংগ্রহের নামে কার্ড বিক্রি করা, খুন-ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মীমাংসা করে দিতে সালিশ-বৈঠকের নামে সুবিধা আদায় করা।

এ বিষয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, নামে-বেনামে প্রতিনিয়ত ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে নামসর্বস্ব মানবাধিকার সংগঠন। এ সংগঠনগুলো সরকারের কোনো বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেই। জবাবদিহিরও বাইরে এদের কার্যক্রম। থানাগুলোতে এদের নিয়মিত যাতায়াত। সেখানে তারা সাধারণ মানুষকে নানা বিপদ থেকে উদ্ধার করার নামে নগদ টাকা হাতিয়ে নেয়।

Share this post

scroll to top