দেশে বিলুপ্তপ্রায় সুস্বাদু ‘রাণী মাছ’র পোনা উৎপাদন করেছে বিজ্ঞানীরা

হলদে রঙের মাঝে কালচে আড়াআড়ি ডোরাকাটা চ্যাপ্টা ও লম্বাটে দেহ বিশিষ্ট অত্যন্ত আকর্ষণীয় চর্বিযুক্ত সুস্বাদু মাছটির নাম ‘রাণী মাছ’। এ মাছটি বউ মাছ, বেটি মাছ, পুতুল মাছ, বেতাঙ্গী মাছ প্রভৃতি আঞ্চলিক নামে খুবই পরিচিত। অনেকেই আবার ‘গাঙ্গ রাণী’ বলেও ডাকে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এ মাছটিকে ‘বিপন্ন’ তালিকাভ‚ক্ত করেছে। আশার কথা হলো, দেশে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া রাণী মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে মাছটি চাষের আওতায় আসবে এবং সহজলভ্য হবে। সর্বোপরি শিগগিরই মাছটি সাধারণ ভোজন রশিকদের খাবার টেবিলে ফিরবে।

আইইউসিএন বাংলাদেশ (২০১৫) এর হিসেব মতে দেশের ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় ইতোমধ্যে পাবদা, গুলশা, টেংরা, বাটা, ফলি, মহাশোল, খলিশা, বৈরালী, ঢেলা, বাতাসী, পিয়ালীসহ ২৯ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করতে সম্ভব হয়েছে। এবার রাণী মাছের পোনা উৎপাদন ইনস্টিটিউটের আরেকটি অন্যতম সাফল্য।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, বিপন্নের তালিকায় দেশীয় প্রজাতির সকল মাছকে পর্যায়ক্রমে পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চলতি বছরে ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ১০টি বিপন্ন প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা শুরু করে। এ পর্যন্ত চলতি প্রজনন মৌসুমে ঢেলা, বাতসি, পিয়ালী ও রাণী মাছসহ সাতটি প্রজাতির মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। গবেষণার সর্বশেষ সাফল্য হলো ‘রাণী মাছ’র পোনা উৎপাদন। গবেষক দলে ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াছমিন, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল, পরিচালক ড. এ এইচ এম কোহিনুর ও স্বাদুপানি কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী।

স্থানীয় প্রবীণরা জানায়, এক সময় হেমন্ত ও শীতকালে জেলেরা পাড়ায় পাড়ায় মাছ বিক্রি করতেন। পাওয়া যেতো প্রচুর তরতাজা সুস্বাদু রাণী মাছসহ দেশীয় নানা প্রজাতির ছোট মাছ। এখন পাড়া-মহল্লায় মৎস্যজীবীরা মাছ বিক্রি করতে আসেন কিন্তু এখন আর রাণী মাছের দেখা মিলে না। এ মাছটির প্রাপ্তি অনেকাংশেই কমে গেছে। বলা যায়, রাণী মাছ দিনে দিনে চোখের আড়াল হয়ে গেছে। কদাচিৎ হাট-বাজারে রানী মাছের দেখা মিললেও দাম শোনে অনেকেই চমকে উঠেন। ময়মনসিংহ নগরীর মিন্টু কলেজ রেলবাজারের মাছ বিক্রেতা মোহাম্মদ সেলিম জানায়, কয়েক বছর ধরেই রাণী মাছের আমদানি কমে গেছে। নেত্রকোনার হাওর এলাকা থেকে মাঝে মধ্যে ছোট সাইজের রাণী মাছ ময়মনসিংহের বাজারে আসে। যা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। ভরা মৌসুমে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জসহ হাওর এলাকা থেকে আঙ্গুলের মতো বড় সাইজের রাণী মাছ কদাচিৎ পাওয়া গেলেও এক থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

বিএফআরআই মহাপরিচালক জানান, স্বাদু পানির বিলুপ্তপ্রায় ছোট মাছের মধ্যে রাণী মাছ অন্যতম। এ মাছটি খেতে খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় বাজারে মাছটির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।ভোজন রশিকদের কাছে রাণী মাছ খুবই প্রিয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, ভুটান ও মায়ানমারে এ মাছ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে রাণী মাছের দু’টি প্রজাতি রয়েছে। একটির বৈজ্ঞানিক নাম Botia dario এবং অপরটির বৈজ্ঞানিক নাম Botia lohachata। এরমধ্যে ইড়ঃরধ ফধৎরড় প্রজাতির রাণী মাছের দেহের রঙ হলুদ এবং দেহে বেশ কিছু (সাধারণত সাতটি) উল্লম্ব কালচে রঙের লম্বা আড়াআড়ি ডোরাকাটা দাগ থাকে। আর Botia lohachata প্রজাতির রাণী মাছের দেহও হলুদ বা হলদেটে। রাণী মাছ দেখতে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এবং চ্যাপ্টা ও লম্বাটে দেহবিশিষ্ট। উভয় মাছেরই মুখ আকারে ছোট এবং চার জোড়া ক্ষুদ্রাকৃতির স্পর্শী থাকে। তবে এর দেহে ইংরেজি ‘ওয়াই’ বর্ণমালার মতো চারটি কালো দাগ থাকে এবং দু’টি দাগের মধ্যবর্তী অংশে একটি কালো দাগ অবস্থিত। তবে Botia lohachata প্রজাতির চেয়ে Botia dario প্রজাতির রাণী মাছ বাংলাদেশে অনেক বেশি পাওয়া যায়। উভয় প্রজাতির মাছের আইশ অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির-যা প্রায় সাধারণ দৃষ্টিতে বোঝাই যায় না। রাণীমাছ প্রায় ৬-৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে সর্বোচ্চ ১৫ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হবার রেকর্ডও রয়েছে। অক্টোবরের শেষ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যখন বিলের পানি কমে যেতে থাকে তখন রাণী মাছ জালে ধরা পড়ে বেশি। এ মাছ খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাওর ইত্যাদির তলদেশে পরিষ্কার পানিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। বউ মাছ প্রায় সব ধরনের স্বাদুপানির জলাশয় যেমন, খাল-বিল, নদী-নালা, হাওড়-বাওড় জলাভ‚মির তলদেশে পরিস্কার পানিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। তবে কখনও কখনও ঘোলা পানিতেও এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এক সময় বাংলাদেশের খাল-বিল, নদ-নদী, হাওড়-বাওড় ও প্লাবনভূমিতে এই মাছ প্রচুর পরিমানে পাওয়া যেতো। জনসংখ্যাবৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ, মাছ ধরার ধ্বংসাত্মক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে যত্রতত্র মাছ আহরণ, মা-মাছ ধরা, জলাশয়ের মধ্যে রাস্তা-ঘাট, বসতবাড়ি নির্মাণসহ অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ ও প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হওয়ায় এ মাছটির প্রাপ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই মাছ ভারত, ভুটান, বাংলাদেশ ও মায়ানমারে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের রক্ষিত বন্যপ্রাণীর তালিকার তফসিল ২ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। ইতোমধ্যে আইইউসিএন (২০১৫) কর্তৃক রাণী মাছকে বিপন্ন প্রজাতির মাছ হিসেবে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে রাণী মাছের সংরক্ষণ, প্রজনন ও পোনা উৎপাদন বিষয়ে গবেষণা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। গবেষণার আওতায় চলতি জুন মাসে দেশে প্রথমবারের মতো রাণী মাছের (Botiadario) প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে।

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরো জানান, দেশের চলনবিল ছাড়াও রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ফরিদপুর, পার্বত্য চট্টগ্রামের জলাশয়ে, বিশেষ করে নদীতে রাণী মাছের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সৌখিনরা রাণী মাছ অ্যাকুয়ারিয়ামে পালন করে। বাণিজ্যিকভাবেও অ্যাকুয়ারিয়ামে রাণী মাছ পালন করা যেতে পারে। স্ত্রী রাণী মাছের চোখের ঠিক সামনে একটি কাটা থাকে যেটি দিয়ে আত্বরক্ষা করে থাকে। এছাড়া এই মাছের মুখে চার জোড়া ছোট বার্বেল থাকে। একটি পূর্ণ বয়স্ক ও প্রজননক্ষম রাণী মাছ সাধারণত ৮-১০ গ্রাম ওজনের হয়। পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী রাণী মাছ অপেক্ষাকৃত আকারে বড় হয়। এ মাছ প্রধানত প্লাঙ্কটন ও পোকামাকড় খায়। গবেষণায় দেখা গেছে, রাণী মাছ মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। জুন-জুলাই এদের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। একটি পরিপক্ক স্ত্রী মাছে প্রতিগ্রামে ৮০০-৯০০ টি ডিম পাওয়া যায়। এ মাছের ডিম্বাশয় এপ্রিল মাস থেকে পরিপক্ক হতে শুরু করে। পরিপক্ক স্ত্রী মাছের জননেন্দ্রীয় গোলাকার ও হালকা লালচে রঙের হয় কিন্তু পুরুষ মাছের জননেন্দ্রীয় পেটের সাথে মেশানো, কিছুটা লম্বাটে ও ছোট হয়। প্রজননের জন্য রাণী মাছ যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও কংশনদী এবং নেত্রকোণার হাওড় থেকে ২০২০ সালে মাছ সংগ্রহ করা হয় এবং গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে প্রতিপালন করা হয়। কৃত্রিম প্রজননের জন্য পুকুর থেকে পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করে কৃত্রিম প্রজননের ৫-৬ ঘন্টা পূর্বে স্ত্রী ও পুরুষ মাছকে হ্যাচারিতে হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয়। ইনজেকশন দেয়ার ১০-১২ ঘন্টা পরে স্ত্রী মাছ ডিম দেয়। ডিম দেয়ার ২২-২৪ ঘন্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম হতে রেণু বের হয়ে আসে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, ডিম নিষিক্ত ও ফোটার হার যথাক্রমে ৭৫% ও ৫০%। রেণুর ডিম্ব থলি ২-৩ দিনের মধ্যে নি:শোষিত হওয়ার পর প্রতিদিন ৩-৪ বার সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে হাঁপায় সরবরাহ করা হয়। হাঁপাতে রেণু পোনা ৬-৭দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তরের উপযোগী হয়।

ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ময়মনসিংহস্থ স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জীন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। দেশীয় মাছ সংরক্ষণ এবং পোনা উৎপাদনে গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২০ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করে। ##

Share this post

scroll to top