দাসদের তৈরি হোয়াইট হাউজে কী আছে

হোয়াইট হাউজ। নামটি শুনলেই মনে পড়ে বিশ্বমোড়ল বাঘা সব মার্কিন প্রেসিডেন্টদের কথা। কারণ এই ভবনটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দেশটির রাজনীতি, ইতিহাস এমনকি ঐতিহ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশা থাকে হোয়াইট হাউজ যেন তাদের হয়। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। ফলে চার বছর পরপর নির্বাচন এলেই বেজে ওঠে যেন যুদ্ধের দামামা।

পৃথিবীবাসীর আজ এ কথা অজানা নয়, ১৩২ কক্ষের ছয়তলার এই বাড়ি থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় বিশ্ব রাজনীতি। সুতরাং কৌতূহল তো থাকবেই। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না হোয়াইট হাউজের মূল ইতিহাস। অনেকেরই এ কথা অজানা- হোয়াইট হাউজ তৈরি হয়েছিল দাসদের পরিশ্রমে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা বলছে, হোয়াইট হাউজের নাম প্রথমে এমন ছিল না। ‘প্রেসিডেন্টস প্যালেস’, ‘প্রেসিডেন্টস হাউস এক্সিকিউটিভ ম্যানশন’ ইত্যাদি বহু নামে এই ভবনটিকে ডাকা হতো। তবে যে নামেই ডাকা হোক, ১৬০০, পেনসিলভেনিয়া অ্যাভিনিউ, ওয়াশিংটন ডিসির এই বাড়িটি বিশ্বের সর্বাধিক বিখ্যাত এবং স্বীকৃত একটি বাড়ি, যেটি রাষ্ট্রপতির বাড়ি, কর্মক্ষেত্র এবং রাষ্ট্রপতির প্রধান কর্মচারীদের সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

হোয়াইট হাউজের নামকরণ

ইতিহাস বলছে, আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন হোয়াইট হাউজের জন্য জায়গাটি ১৭৯১ সালে নির্বাচন করেন। জন্মসূত্রে আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী জেমস হোবানের নকশা অনুসারে ১৭৯২ সালের ১৩ অক্টোবর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তখন বাড়িটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল ধূসর রঙের পাথর। দাস শ্রমিকেরা হোয়াইট হাউজ তৈরিতে সহায়তা করেছিল। ভিত্তিপ্রস্তরের পরবর্তী আট বছরে, বিনা পারিশ্রমিকে আফ্রিকান ক্রীতদাস শ্রমিক এবং আমেরিকান দক্ষ কারিগরদের পরিশ্রমে হোয়াইট হাউজ তৈরি হয় ১৮০০ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রাসাদ হিসেবে ভবনটিকে আখ্যায়িত করা হতো তখন। কেননা সে সময় ভবনটির নির্মাণ ব্যয় ছিল ২ লাখ ৩২ হাজার ডলারেরও বেশি। যা বর্তমানে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

নির্মাণ শেষ হওয়ার ১২ বছর পরের কথা। ১৮১২ সালে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। যুদ্ধ চলাকালে ১৮১৪ সালের ২৪ আগস্ট ব্রিটিশ সেনাবাহিনী হোয়াইট হাউজ জ্বালিয়ে দেয়। যুদ্ধ শেষে সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর জেমস হোবানের পরামর্শ মতো আবার এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৮১৭ সালে। এবার ভবনের বিভিন্ন জায়গায় আগুনের পোড়া দাগ ঢাকতে সাদা রং ব্যবহার করা হয়। বলা হয়ে থাকে, হোয়াইট হাউজের বাইরের দেয়াল সাদা রং করতে ৫৭০ গ্যালন রঙের প্রয়োজন হয়েছিল। ধবধবে সাদা এই ভবনটিকে এরপর থেকে অনেকেই ‘হোয়াইট হাউজ’ বলে ডাকতে শুরু করেন। যদিও সরকারিভাবে এই নামের প্রবর্তন হয় আরও পরে। ১৯০১ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট সরকারিভাবে বিভিন্ন কাগজপত্রে এই নামটি ব্যবহার শুরু করেন।

হোয়াইট হাউজে কী আছে?

বর্তমানে হোয়াইট হাউজে ১৩২টি কক্ষের পাশাপাশি ১৬টি পরিবার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কিচেন আছে তিন রকমের। একটি মূল রান্নাঘর, একটি ডায়েট কিচেন এবং অন্যটি পারিবারিক রান্নাঘর। এখান থেকে প্রতিদিন ১৪০ জন অতিথিকে আপ্যায়ন করা হয়। তবে যেসব বাবুর্চি ও পরিচারক আছেন তারা এক হাজারেরও বেশি অতিথিকে রাতের খাবার পরিবেশন করতে সক্ষম। হোয়াইট হাউজে ৪১২টি দরজা, ১৪৭টি জানালা, ২৮টি ফায়ার প্লেস, ৮টি সিঁড়ি, ৩টি লিফট এবং ৩৫টি বাথরুম রয়েছে। এখানে কাজ করেন ১৭ হাজার কর্মী এবং কর্মকর্তা। ভবনটিতে একটি সিনেমা থিয়েটার, ইনডোর এবং আউটডোর পুল, বিলিয়ার্ড এবং পিংপং টেবিলসহ একটি খেলার রুম, জগিং ট্র্যাক এবং টেনিস কোর্ট রয়েছে।

পৃথিবীর নানা প্রান্ত হতে প্রতি সপ্তাহে হোয়াইট হাউজে ৩০ হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী আসেন। এ ছাড়া সপ্তাহব্যাপী ৬৫ হাজার চিঠি, প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ফোনকল, ১ লাখ ই-মেইল এবং ১ হাজার ফ্যাক্স হোয়াইট হাউজের ঠিকানায় আসে। হোয়াইট হাউজের বেজমেন্টে প্রেসিডেন্ট পরিবারের দাঁতের চিকিৎসায় ব্যক্তিগত ডেন্টিস্টের জন্য রয়েছে অফিস। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, হোয়াইট হাউজের ক্ষমতার পালাবদলে প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারকে এই ভবনটি ছেড়ে যেতে মাত্র ৬ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। এ জন্য ৯৩ জন কর্মী মালপত্র গুটিয়ে নিতে সাহায্য করেন।

হোয়াইট হাউজে ভূত

আধুনিক সভ্যতা যখন ভূত বিশ্বাস করছে না, তখন খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডজনখানেক ভূত! এমন বিশ্বাস কেবল ভৌতিক গল্পপ্রিয় সাধারণ আমেরিকানদেরই নয়, হোয়াইট হাউজের একাধিক বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বলে দাবি করেন। হোয়াইট হাউজের পূর্ব দিকের একটি কক্ষে প্রায়ই কাজে ব্যস্ত থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ফার্স্ট লেডি এবিগেইল অ্যাডামস। অথচ তিনি মারা গেছেন অনেক আগে। আবার মৃত্যুর পরও বাগানে কাজ করে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউজের কর্মচারী ডলি ম্যাডিসন। শুধু তাই নয়, আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন, রুজভেল্ট, হ্যারিসন, রিগ্যান, অ্যান্ড্রু জ্যাকসনসহ আরও অনেকের প্রেতাত্মা এখনো দিব্যি ঘুরে বেড়ায় হোয়াইট হাউজে। হিস্ট্রি ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাবেক ফার্স্ট লেডি লরা বুশ দাবি করেছিলেন- তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অর্ধনগ্ন হয়ে হোয়াইট হাউজে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন!

হোয়াইট হাউজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বিশ্বের পরাক্রমশালী প্রেসিডেন্টের বাসভবন বলে কথা! নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর হবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি হোয়াইট হাউজে ভ্রমণ করতে চান তবে কমপক্ষে ২১ কর্ম দিবস আগে আবেদন করতে হবে। এরপর সেই আবেদন যাচাই বাছাই করে ভ্রমণের অনুমতি দেয় হোয়াইট হাউজ প্রশাসন। ভবনে রয়েছে বুলেটপ্রুফ উইন্ডো। ভেতর থেকে সব দেখা গেলেও বাইরে থেকে দেখা সম্ভব নয়। ভবনের প্রতি ইঞ্চি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইনফ্রারেড লেজার দ্বারা সুরক্ষিত। এর মাধ্যমে সহজেই অপরাধীকে সনাক্ত করা যায়। ভবনের আশপাশে অসংখ্য এয়ার মিসাইল স্থাপন করা আছে। যেহেতু ওয়াশিংটন ডিসির আকাশে প্রচুর বিমান ওড়ে। পাশেই রোনাল্ড রেগান জাতীয় বিমানবন্দরে প্রবেশের নির্ধারিত বা কঠোর পথ অনুসরণ না করা কোনো বিমানকে প্রথমে একটি সতর্ক সংকেত দেওয়া হয়। যদি তারা অবিলম্বে কোনো প্রতিউত্তর না দেয় তবে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ধ্বংস করা হয়। এছাড়াও হোয়াইট হাউজের নিরাপত্তায় সর্বদা প্রস্তুত থাকে ড্রোনসহ নানা সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সিক্রেট সার্ভিস। প্রেসিডেন্টকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিশেষ বাহিনী তো আছেই।

Share this post

scroll to top