ট্যুরিস্ট ভিসার নেপথ্যে মানবপাচার!

লিবিয়ার ঘটনা নাড়া দিয়েছে প্রশাসনকে। মানব পাচারকারীদের ধরতে গোয়েন্দা সদস্যরা এখন মাঠে। সারা দেশেই অভিযান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, এ পর্যন্ত ডজনখানেকেরও বেশি মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে। চক্রটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সারা দেশে ২২টি মামলা করেছেন ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা। এসব মামলার মধ্যে ১২টির তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বাকিগুলো তদন্ত করছে র‌্যাব ও ডিবির টিম।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রধানরা বলছেন, মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। সম্প্রতি মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে কুয়েতে গ্রেফতার হয়েছেন লক্ষ্মীপুরের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। দেশটির আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম খবর দিয়েছে। এ ঘটনায় তার স্ত্রীর দাবি, তার স্বামীকে কুয়েত সিআইডি পুলিশ ব্যবসায়িক কাজে কথাবার্তার জন্য ডেকেছিল। তবে পরে তাকে দেশটির পুলিশ ছেড়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।

প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে শত শত মানুষকে ভালো চাকরির প্রলোভনে একটি চক্র ইউরোপে পাচার করছে। তারা প্রথমে ঢাকা থেকে ভারত, তারপর দুবাই, জর্ডান হয়ে লিবিয়ায় নেয়ার পরই নির্যাতন চালিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছে অর্থ আদায় করত। কেউ অর্থ দিতে পারলে জীবিত ছেড়ে দেয় মানব পাচারকারীরা, অন্যদিকে যারা অর্থ দিতে পারছে না তাদের ভাগ্যে জুটছে মৃত্যু।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ট্যুরিস্ট ভিসার নেপথ্যেই চলত মানবপাচার। ডিবির তথ্য মতে, লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রটি পাঁচটি রুট ব্যবহার করত। প্রত্যেক রুটে পাচারের শিকার ব্যক্তিকে পাঠানোর আগে পরানো হতো বিশেষ রঙের পোশাক। এসব রুটে যাওয়ার জন্য পাচারকারীরা প্রথমে ঢাকা থেকে পাচারের শিকার ব্যক্তিকে ভারতে নিতো। ভারতে পাঠানোর কাজ করত সুজন, মামুন, নাজমুল ও কাউসার। আর ভারতে কাজ করত বাংলাদেশী দালাল কাউসার ও নাজমুল।

এরপর তৃতীয় ধাপে পাঠানো হতো দুবাইয়ে। সেখানে আফ্রীন নামের এক ব্যক্তি ওই সব ব্যক্তিকে গ্রহণ করতেন। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের গায়ে পরানো হতো নীল টি-শার্ট।

দুবাইয়ের আফ্রীন পাঠাত জর্ডানের আম্মান শহরে। এই শহরে পাঠানো হতো টিয়ে রঙের টি-শার্ট পরিয়ে। যাতে বিমানবন্দর বা সীমান্তে চিনতে সুবিধা হয়। এরপর সেখান থেকে জর্ডানের এক নাগরিক পাচারের শিকার ব্যক্তিদের গ্রহণ করে। জর্ডান থেকে আবার পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজীতে। যেখানে বাংলাদেশী দালাল সজীব, মানিক, জাফর ও এক লিবিয়ান নাগরিক থাকেন। তারা সেখানে মাসখানেক আটকে রেখে পাচারের শিকার ব্যক্তির পরিবারকে ফোন দিয়ে নির্যাতন ও কান্নার শব্দ শোনাত। এরপর কোনো পরিবার টাকা পাঠালে পাচারের শিকার ব্যক্তি বেঁচে যেতো আর না পাঠালে নির্ঘাত মৃত্যু।

শেষ ধাপে দালালরা টাকা হাতে পেলে ইতালির উদ্দেশে পাচারের শিকারদের পাঠানোর জন্য লিবিয়ান দালালদের হাতে তুলে দিতো। তারাই নৌকা বা বোটে চড়িয়ে ইতালিতে পাঠিয়ে দিতো। পথে অনেকের সলিল সমাধি ঘটত, কেউ কেউ ইউরোপে পৌঁছাতেন।

সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো: আবদুল বাতেন বলেন, লিবিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে কাজ ও সেখান থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশী দালালরা অন-অ্যারাইভাল ও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে লোকজনকে পাচার করে। লিবিয়ায় পাচারের পর ভিকটিমদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে নির্যাতিতদের কান্নাকাটি, আকুতি-মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবার্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের বাবা-মা আত্মীয়স্বজনদের পাঠিয়ে টাকা দাবি করে। সন্তানকে বাঁচাতে পরিবার অনেক ক্ষেত্রে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে টাকা পাঠাত।

তিনি জানান, নিহত মাদারীপুরের সাতজনকে লিবিয়ায় আমির হোসেনের কাছে পাচার করেছিল তার ভাই গ্রেফতার আকবর আলী। অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত বাদশা মিয়া ১৩ বছর ধরে লিবিয়ায় অবস্থান করেছেন। লিবিয়ার বেনগাজী জোয়ারা শহরে তার নিজস্ব ক্যাম্প আছে। পুরো বাংলাদেশ থেকে নিয়মিত লিবিয়ায় মানবপাচার করতেন তিনি।

সোমবার ডিবি লিবিয়ার ঘটনায় মোহাম্মদ আলী নামের এক ব্যক্তির দায়ের করা তেজগাঁও থানার মামলায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন- বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু। এ সময় তাদের হেফাজত থেকে চারটি পাসপোর্ট, দু’টি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সংবলিত দু’টি নোট বুক উদ্ধার করা হয়।

ডিবি বলছে, মানবপাচারে সক্রিয় দেশীয় দালালরা বেনগাজিতে মানবপাচারের জন্য স্থানীয় দালালদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্ট স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই এবং লিবিয়ায় পাঠায়। সেখান থেকে ট্যুরিস্ট ভিসা এবং অন অ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করার পরে বেনগাজিতে ক্যাম্পে থাকা নির্ধারণ করে। এরপর বিভিন্ন চুক্তিতে ভিকটিমদের লিবিয়া পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করে দালালরা।

ডিবির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার শাহাদাত হোসেন বলেন, লিবিয়ায় মানবপাচারকারী চক্রের মধ্যে আটক সুজন ও সজীবও জড়িত। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়।

এদিকে মানবপাচারের মামলায় সিআইডিও তদন্তে নেমেছে। সারা দেশে দায়ের হওয়া ২২ মামলার মধ্যে শুধু সিআইডি তদন্ত করছে ১২টি। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির টিম। সোমবারও সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম টিম ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চাালিয়ে মানব পাচার চক্রের তিনজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তারা হলেন- সোহাগ হোসেন (৫০), খালিদ চৌধুরী (৪২) ও সানজিদা (৩৮)। সিআইডির মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ওমর ফারুক বলেন, আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত ছয়জন গ্রেফতার হয়েছে।

এ ছাড়া ওই ঘটনায় প্রথম থেকেই ছায়া তদন্ত করছে র‌্যাব। তারাই প্রথম লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হোতা হাজী কামালকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এই কামালকে ধরার পরই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। র্যাবের মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, লিবিয়ায় যে ঘটনাটি ঘটেছে তা মর্মান্তিক। আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশে এর মূল হোতাকে গ্রেফতার করেছি। এই মুহূর্তেও আমাদের অভিযান চলছে। আমাদের অপারেশনাল কার্যক্রম চলছে। গোয়েন্দা টিম কাজ করছে। আমরা মানব পাচার নিয়েও একইভাবে কাজ করছি।

Share this post

scroll to top