জালিয়াতির দায়ে বরখাস্ত শিক্ষককে আবারও পুনর্বহাল করেছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড

Edu-mymensinghজালিয়াতির দায়ে বরখাস্ত সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিমকে এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে আবারও প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়েছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। আদালতে মামলা চলমান অবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ নির্দেশনা অমান্য করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এই নির্দেশ দেন ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক ড. মো. দিদারুল ইসলাম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগে নিয়োগ জালিয়াতির দায়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতি উপজেলার হাজি অছি আমরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিমের এমপিও বাতিল করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। একইসঙ্গে তার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই মামলা এখনও বিচারাধীন আছে।

জানা গেছে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর বরখাস্ত হওয়া সহকারী শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর সেলিমকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আবারও পুনর্বহালের নির্দেশ দেয় ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। এর আগে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাকে পুনর্বহাল করতে চিঠি দিয়েছিলেন শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক ড. মো. দিদারুল ইসলাম। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে জাহাঙ্গীর সেলিমের জাল কাগজপত্র জমা দিলে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পুনর্বহালের ওই চিঠি স্থগিত করেন এই কলেজ পরিদর্শক।

যেসব যুক্তিতে পুনর্বহালের চিঠি

শিক্ষা বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক ড. মো. দিদারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গত ১৪ সেপ্টেম্বরের পুনর্বহালের চিঠিতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল ইস্যু করা চিঠির নির্দেশনা, ৪১২৪/২০১৭ নম্বর রিট পিটিশনের আদেশ, হাইকোর্টে দায়ের করা ৯০/২০১৯ নম্বর কনটেম্পট পিটিশনের আদেশ এবং জাহাঙ্গীর সেলিমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হলো।।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মানা হয়নি

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল ইস্যু করা যে চিঠির উল্লেখ করে শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিমকে পুনর্বহাল করা হয়েছে, তা নিয়ে মামলা চলছে নিম্ন আদালতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন বিদ্যালয়টির বর্তমান প্রধান শিক্ষক উম্মে কুলসুম। ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগ রিট খারিজ করে পর্যবেক্ষণ দেন। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘অভিযোগটি নিম্ন আদালতে বিচার্য বিষয়।’ এরপর বাদী উম্মে কুলসুম নিম্ন আদালতে মামলা করেন।

এছাড়া ওই চিঠির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি উভয়পক্ষের শুনানির মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চলতি বছর ১৮ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের নির্দেশ দেয়। করোনার কারণে শুনানির দিন এখনও নির্ধারণ হয়নি। অথচ শুনানি শেষ না হতেই পুনর্বহালের চিঠি দেয় শিক্ষা বোর্ড।

আদালতের আদেশও মানেনি শিক্ষা বোর্ড

প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনর্বহালে রিট পিটিশনের (৪১২৪/২০১৭) আদেশের উল্লেখ করেছে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড। কিন্তু ওই রিট পিটিশনের ২০১৭ সালের ২ এপ্রিলের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশে বিষয়টি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন আদালত। আদালত কাউকে পুনর্বহালের আদেশ দেননি।

আদালত অবমাননার মামলা

আদালতের দেওয়া নিষ্পত্তির আদেশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেওয়ায় দুই বছরের মাথায় ২০১৯ সালের ৩ মার্চ জাহাঙ্গীর সেলিম আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন শিক্ষা বোর্ডের বিরুদ্ধে। ওই মামলা কোনও আদেশ বা রায় হয়নি। অথচ শিক্ষা বোর্ডের চিঠিতে ‘মামলার আদেশের’ বরাত দেওয়া হয়েছে। পুনর্বহালের চিঠিতে বলা হয়েছে ‘কনটেম্পট পিটিশনের আদেশ’।

জাহাঙ্গীর সেলিমের নতুন আবেদন

প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনর্বহালে শিক্ষা বোর্ডের চিঠির সর্বশেষ যুক্তি— প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনর্বহাল চেয়ে শিক্ষা বোর্ডে আবেদন করেন বরখাস্ত হওয়া শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিম। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল পরিদর্শক তাকে পুনর্বহালের চিঠি ইস্যু করেন। বাস্তবতা হচ্ছে, আদালতের আদেশ ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে মামলা চলমান থাকার পরও শিক্ষাবোর্ড স্কুল কর্তৃপক্ষের বরাবর জাহাঙ্গীর সেলিমকে পুনর্বহালের চিঠি দেয়।

আগের পুনর্বহালের চিঠি স্থগিত

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের আপিল অ্যান্ড আরবিট্রেশন বোর্ড চূড়ান্ত বরখাস্তের অনুমোদন দেয় ২০১৫ সালের ১৭ নভেম্বর। এই অনুমোদনের বিরুদ্ধে সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিম হাইকোর্টে ২০১৬ সালের ৩১ জুলাই রিট পিটিশন (৯৩/৯৯) দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে চলমান। মামলা চলমান থাকাকালেই জাহাঙ্গীর সেলিম ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাল কাগজ তৈরি করে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে জমা দিয়ে পুনর্বহাল চান। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাকে পুনর্বহাল করতে চিঠি দেয় শিক্ষা বোর্ড। তবে কাগজপত্র চ্যালেঞ্জের পর জাল সন্দেহে তার পুনর্বহালের চিঠিটি ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থগিত করে শিক্ষা বোর্ড।

স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ

স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ— মামলা চলমান থাকাকালে পুনর্বহালের আবেদন করতে পারেন না বরখাস্ত হওয়া শিক্ষক। একইসঙ্গে শিক্ষা বোর্ড এই আবেদন গ্রহণ করে কোনও সিদ্ধান্তও দিতে পারে না। প্রসঙ্গত, ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড স্থাপনের পর ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে থাকা ওই অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব কাগজপত্র ময়মনসিংহ বোর্ডে স্থানান্তর করা হয়।

অভিযোগ আছে, ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ২০১৩ সালের ১৩ জুন হাজি অছি আমরুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর সেলিম শূন্য পদের বিপরীতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেন। এরপর জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে এমপিও পান ২০১৩ সালের নভেম্বরে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পদক্ষেপ

শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিমের জালিয়াতির ঘটনায় এমপিও স্থগিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে এমপিও তালিকা থেকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের নাম বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেন শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ম্যানেজিং কমিটিকে মামলা করার নির্দেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়ের করা সেই মামলটি বর্তমানে চলমান।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের বক্তব্য

এ পরিস্থিতিতে জাহাঙ্গীর সেলিমকে প্রধান শিক্ষক পদে পুনর্বহালে ইস্যু করা চিঠির বিষয়ে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে লিখিত অভিযোগ করেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান প্রধান শিক্ষক উম্ম কুলসুম। উম্মে কুলসুম বলেন, ‘এখনও আদালতে ১৩টি মামলা চলমান রয়েছে। তাছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে উভয়পক্ষের শুনানি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় জালিয়াতি ও দীর্ঘকাল অনুপস্থিতির কারণে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত সহকারী শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পুনর্বহালে কেন চিঠি দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারছি না। কোনও ধরনের স্বার্থ ছাড়া এই চিঠি দেওয়ার যুক্তি নেই।’

ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের বক্তব্য

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. গাজী হাসান কামাল বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক বছর আগের চিঠি অনুযায়ী ওই শিক্ষককে পুনর্বহালের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের আইন উপদেষ্টা রয়েছেন। আপনি চাইলে তার সঙ্গে কথা বলতে পারেন। ’ এরপর বোর্ডের আইন উপদেষ্টা মো.মশিউল আলমের সঙ্গে এ প্রতিবেদককে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য অধ্যাপক ড. গাজী হাসান তার মোবাইল ফোনটি অন্য একজনকে দেন । চেয়ারম্যানের মোবাইল ফোন থেকে শিক্ষা বোর্ডের আইন উপদেষ্টা পরিচয়দানকারী মশিউল আলম বলেন, ‘কনটেম্প্ট পিটিশনের কারণে জাহাঙ্গীর সেলিম আবেদন করেছেন চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান নির্দেশনা দিয়েছেন স্কুল শাখাকে। স্কুল শাখা ফাইল ইনিশিয়েট করেছে। হাইকোর্টেও আমাদের আইন উপদেষ্টা আছেন। তার মতামত নিয়ে ফাইলটা অনুমোদন দিয়েছেন। ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনও বক্তব্য থাকলে কথা বলে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ’

টাকার বিনিময়ে এই চিঠি ইস্যু করা হয়েছে এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘এগুলো যে কেউ বলতেই পারেন।’ বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষককে বিষয়টি তুলে ধরে আবেদন করারও পরামর্শ দেন এই আইন উপদেষ্টা।

বরখাস্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর সেলিমকে প্রধান শিক্ষকের পদে পুনর্বহালের নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক ড. মো. দিদারুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে তাকে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তার মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েও কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

Share this post

scroll to top