চাপে পড়বে বাংলাদেশ ব্যাংক

অর্থনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক দিতে হয়, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়। বর্তমানে দেশের অথনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংক দেয়ার কোনোই প্রয়োজন নেই। অথচ ১০টি নতুন ব্যাংকের সাথে আরো তিনটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা বেড়ে যাবে। ঋণ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। আর অধিকসংখ্যক নতুন ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে চাপে পড়ে যাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন তিন ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে গতকাল নয়া দিগন্তের কাছে অর্থনীতিবিদরা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দেশের ভৌগলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় এমনিতেই ব্যাংকের সংখ্যা অনেক হয়ে গেছে। এ কারণে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রায় শতাধিক আবেদন থাকলেও তখন একটিও নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়নি। রাজনৈতিক চাপ ছিল।

কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায় ওই সময়কালে কোনো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়নি। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে আবারো নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যে ৯টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয় তাদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।

ইতোমধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। তারা সাধারণ আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। এমডিকে অপসারণ করা হয়। ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য সরকারি পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থেকে মূলধন জোগান দেয়া হচ্ছে। এখন আবার ব্যাংকটি গ্রাহকের আস্থার সঙ্কট কাটানোর জন্য নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম ধারণ করেছে। সাবেক এ গভর্নর বলেন, নতুন ব্যাংকগুলো অর্থনীতিতে নতুন কিছু করতে পারেনি। নতুন কোনো সেবা আনতে পারেনি। পুরনো ধাঁচেই তারা ব্যাংকিং করছে।

নতুন ব্যাংকের এমন অভিজ্ঞতার পরেও রাজনৈতিক বিবেচনায় আরো তিন ব্যাংকের অনুমোদন কোনোক্রমেই ঠিক হয়নি। তিনি মনে করেন, ব্যাংক অনুমোদন দিতে হবে অর্থনৈতিক বিবেচনায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন ব্যাংকিং খাতে শুধু অব্যবস্থাপনাই বাড়বে না, ঋণ শৃঙ্খলা আরো বিনষ্ট হবে। খেলাপি ঋণ আরো বেড়ে যাবে। অধিকসংখ্যক ব্যাংক তদারকি, নিয়ন্ত্রণ করাও চাপে পড়ে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত ২৫ বছরে দেশে বেসরকারি ব্যাংক ছিল ১৭টি। অপর দিকে জেনারেল ও লাইফ মিলে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ছিল ৩২টি। গত ১৯৯৬-২০০০ সালের মধ্যে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৩টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়। আর ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স দেয়া হয় ২৮টির। ইন্স্যুরেন্সগুলোর মধ্যে জেনারেল ১৯টি ও লাইফ ৯টি।

গত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের পাঁচ বছর এবং পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর মোট আট বছরে কোনো নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়নি। ২০১২ সাল থেকে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়। বর্তমান সরকারের চলমান আগের দুই মেয়াদে লাইসেন্সে দেয়া হয় নতুন ১০ ব্যাংকের। টানা তৃতীয় মেয়াদের দেড় মাসের মাথায় আরো তিন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। ফলে সব মিলে দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়াল ৬২টি। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকই ৪৫টি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই, এ কথা বার বার বলা হয়েছে। আগের ৯ ব্যাংক অনুমোদনের আগে ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত : একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন পেশ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছিল, প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার আয়তন, জনসংখ্যার ঘনত্বের তুলনায় বাংলাদেশে নতুন ব্যাংক দেয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কিন্তু এ প্রতিবেদনকে তোয়াক্কা না করে ওই সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও সরকারের বাইরে নয়। এ কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সামনে কোনো উপায় থাকে না। এ কারণে নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়।

নতুন ব্যাংকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে খোদ বিরোধিতা করেছিলেন সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সরকারের গত মেয়াদের শেষ সময়ে চারটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন এ চার ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়ার আগে স্বয়ং অখুশি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী।

গত ১ নভেম্বর অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরামের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। এর পরেও চারটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন করা হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়।

তিনি বলেন, এভাবে ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ায় আমি খুবই অখুশি। এর আগেও গত ২৪ অক্টোবর সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষেও সাবেক অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাত খুব বেশি বড় হয়ে গেছে। অনেক ব্যাংক অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুটোই বেশি। এটা মনে হয় একটু সীমিতকরণ (কনসুলেশন) দরকার হতে পারে।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top