খালেদা জিয়ার জামিন প্রসঙ্গ প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন চায় বিএনপি

ন্যায় বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের বাস্তবায়ন দেখতে চায় বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এদেশের জনগণের প্রাণপ্রিয় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিনা অপরাধে ৬৭২ দিন ধরে নির্দয়ভাবে বন্দী রাখা হয়েছে। মানসিক নিপীড়ণে ৭৫ বছর বয়সী গুরুতর অসুস্থ দেশনেত্রীর অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। সেই কারণেই সরকার তার জীবনকে আরো বিপন্ন করার জন্য জামিন দিচ্ছে না। যে কোনো সময় তার স্থায়ী পঙ্গুত্বের আশঙ্কা রয়েছে। দেশের জনগণ তাদের নয়নমনি দেশনেত্রীকে নিয়ে প্রতিমুহুর্ত গভীর উৎকন্ঠায় কালাতিপাত করছেন। আগামীকাল তার জামিনের শুনানি হবে। দেশের মানুষ গভীর আশা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।

রিজভী বলেন, দু:শাসনকবলিত মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল ও ভরসার জায়গা হলো দেশের বিচারালয়। আমরা এখনো বিচার বিভাগকে বিশ্বাস করি। বিশেষ করে সুপ্রিকোর্ট নিরপেক্ষ থেকে ন্যায়বিচার করবেন, আইনের শাসন কায়েম থাকবে। আমরা আশা করি, মহামান্য আদালত চারবারের সাবেক প্রধনমন্ত্রীকে তার প্রাপ্য হক জামিন দিয়ে মুক্ত পরিবেশে পছন্দমতো হাসপাতালে স্বাধীনভাবে সুচিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেবেন। আইন, সংবিধান, মানবাধিকার, বয়সসহ সকল বিবেচনা অনুযায়ী জামিন পাওয়া তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার। দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা চেয়ারপারসনের জামিন নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন। আমরা আশা করি উচ্চ আদালত সবকিছু বিবেচনা করে সঠিক রায় দেবেন।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে মানবাধিকার রক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর। আমাদের বিচার বিভাগ যেন স্বাধীনভাবে কাজ করে সেই স্বাধীনতাও আমরা বিচার বিভাগকে নিশ্চিত করে দিয়েছি, মানুষ যাতে ন্যায় বিচার পায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে।’

আমরা বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ আদালতে প্রধানমন্ত্রীর এই কথা ও অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তিনি যে মানবাধিকারকে পদদলিত, সমগ্র বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে ন্যায়বিচারের টুঁটি চেপে ধরে মিথ্যাবাদীতার নীতি নিয়ে তিনি যে সরকার পরিচালনা করছেন সেখান থেকে সরে আসার নজীর সৃষ্টি হবে, তিনি যদি আদালতকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন। গোটা দেশবাসী গভীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছে। জামিন আটকে দিতে আদালতে নগ্ন হস্তক্ষেপ করবেন না। ন্যায়বিচারে বাধা দিবেন না। মানবিক কারণে দেশনেত্রীর জামিন দিন। তার জামিনই এখন দেশবাসীর কাছে মুখ্য। তাহলেই বোঝা যাবে, প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের সাথে কাজের মিল আছে।

রিজভী বলেন, সোমবার ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বহুল আলোচিত নাগরিকত্ব বিল পাস হয়, ‘যাতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে যাওয়া অমুসলিমদের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে শুধু মুসলিমদেরকে কোনো নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।’ এই বিল পাশ হচ্ছে ফ্যাসিবাদের নব্য সংস্করণ। এখন থেকে তারা ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ বলে ভারতের মাটিতে অবৈধ হয়ে গেলো। এরপর রাতারাতি ভারতের এই মুসলিম নাগরিকরা রাস্তার ফকিরে পরিণত হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পের বদ্ধ কারাগারে থাকতে বাধ্য হবেন।

তিনি বলেন, এটাতো শুধু এক আসামের ঘটনা। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ’র ঘোষণা মতে পুরো ভারতজুড়ে তারা এনআরসি করতে চান। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম নাগরিকদের পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান থেকে আগত ‘অনুপ্রবেশকারী’ ঘোষণা দিয়ে তাদেরকে নাগরিকত্বহীন করার মাধ্যমে তাদের বাড়ি-ঘর ক্রোক করে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকানো হবে। ফলে বাংলাদেশ অচিরেই নাগরিকত্ববিহীন ভারতীয় মুসলিম নাগরিকের ভয়ঙ্কর পুশইন তান্ডবের শিকারে পরিণত হতে পারে। ইতিমধ্যেই অবৈধভাবে ভারতীয় নাগরিকদের গণহারে পুশইন শুরু হয়ে গেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অদ্যাবধি এটা জানেনই না বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন! অথচ ভারতের নানা প্রান্ত থেকে ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়ে অসংখ্য মুসলিম নারী-পুরুষদের আটক করে দলে দলে কলকাতায় নিয়ে এসে গোপনে ও জোর করে সীমান্ত পার করে দেয়া হচ্ছে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে। যা খোদ ভারতের সংবাদ মাধ্যমেই প্রকাশ পেয়েছে।

অমিত শাহ সত্যভ্রষ্ট : রিজভী বলেন, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনে বিএনপিকে অভিযুক্ত করে ন্যাক্কারজনক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি সরাসরি বিএনপির নামোল্লেখ করে অভিযোগ তুলেছেন যে, এই আমলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন অনেক বেশি হয়েছে। অমিত শাহ সত্যভ্রষ্ট। তার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন জঘন্য মিথ্যা অভিযোগ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। এটার তীব্র নিন্দা এবং এই ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রত্যাহারের আহবান জানাচ্ছি। আমরা দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলছি, বিএনপি সরকারের আমলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে সবচেয়ে বেশী। বরং অমিত শাহদের আশির্বাদপুষ্ট আওয়ামী লীগের সময়ে তাদের ওপর কমবেশী নির্যাতন হয়েছে। বিএনপি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। প্রতিটি নাগরিকের ধর্মপালনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আমরা সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বিভাজনে বিশ্বাসী নই।

আমাদের সরকারের আমলে কেউ আইন ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে সর্বত্র সম্প্রীতি বজায় রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়। কোথাও অমুসলিম নাগরিকদের ওপর কোনো অত্যাচারের সুযোগ কাউকে দেয়া হয়নি। বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারকারী আওয়ামী শাসনামলেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর আঘাত এসেছে।

রিজভী জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও আওয়ামী লীগ সমর্থক ড. আবুল বারাকাতের গবেষণা ‘বাংলাদেশে কৃষি ভূমি জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি-২০১৬’ ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, স্বাধীনতার পর থেকে এই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যত অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ণ হয়েছে এবং তাদের যত জায়গা-জমি-সহায় সম্পদ দখল হয়েছে তা আওয়ামী লীগের দ্বারাই হয়েছে। সুতরাং বিএনপির ওপর দায় চাপিয়ে অমিত শাহ’র এই বক্তব্য শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং সৎ প্রতিবেশীসূলভ সম্পর্কের ক্ষেত্রে অশুভ ইঙ্গিতবাহী। একটি দলকে কব্জায় নিয়ে বাংলাদেশে তারা যে আধিপত্য বজায় রেখেছেন, সেটিরই বহি:প্রকাশ।

মামলার নিন্দা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকির কাল্পনিক অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘জননেত্রী পরিষদ’র সভাপতি এ বি সিদ্দিকী কর্তৃক মামলা দায়েরের ঘটনায় রিজভী বলেন, এ ধরনের অভিযোগ কেবল সমাজে মামলাবাজ টাউটদের দ্বারাই সম্ভব। এই ব্যক্তিটি দেউলিয়া ও ছন্নছাড়া ব্যক্তি বলেই সরকার তাকে নির্দেশ দিয়ে এধরনের মামলাগুলো দায়ের করায়। আমি ভিত্তিহীন মামলার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার এবং অবিলম্বে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাই।

কর্মসূচি: শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিএনপির উদ্যোগে শনিবার সকালে মিরপুরস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে পুস্পার্ঘ অর্পণ ও রোববার ২ টায় সুপ্রীম কোর্ট বার মিলনায়তনে আলোচনা সভা হবে। বিজয় দিবস উপলক্ষে বুধবার ২ টায় গুলিস্তানস্থ মহানগর নাট্যমঞ্চে আলোচনা সভা হবে। নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনে দলের নেতা আহমেদ আযম খান, মুনির হোসেন, সেলিমুজ্জামান, আ ক ম মোজাম্মেল হক, খান রবিউল ইসলাম, আনোয়ার হোসাইন, ঢাবি ছাত্রদলের তরিকুল ইসলাম, মাসুদুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

Share this post

scroll to top