কালের উচ্চশির কবি

আল মাহমুদ আর নেই। শুভ শুক্রবার তিনি মৃত্যুকে বরণ করতে চেয়েছিলেন। এ দিনই তিনি ‘ঈদ’ কবুল করেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘কোনও এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে/মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ/অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে/ভালোমন্দ যা ঘটুক, মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’

শুক্রবারেই চলে গেলেন আল মাহমুদ। বাংলা ভাষার এই মহান কবিকে তার রাষ্ট্র কোনো সম্মান বা স্বীকৃতি দিতে পারেনি। দীর্ঘ আট দশকের জীবনে বাংলা কবিতার জন্য, সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে, ‘মাকে নোলক পরিয়ে দিতে’ অনেক কিছু করেছেন, অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন উচ্চশিরে। কিন্তু আমরা রাজধানীর বিশ্ব বিদ্যাপীঠে জাতীয় কবির পাশে অথবা বুদ্ধিজীবীদের কবরস্থানে তার জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গাও রাখিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল এলাকায়, মা-বাবার পাশে তিনি শুয়ে আছেন।

পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত কবি মৃদুল দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘আমাদের কালের মহাকবি ছিলেন তিনি। তামাম বাংলা ভাষার কবি আল মাহমুদ প্রয়াত হলেন। ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো যেন মনে। বিশ্বজগৎ মনে হলো অন্ধকার। সেই আঁধারে, নিকষ আঁধারে ডানার শব্দ শুনতে পেলাম, দেখলামও শ্বেত পোশাকের দেবদূতরা নেমে আসছেন, এই নাস্তিকেরও মনে হলো, ওই তো রামধনুর সাতটি রঙের পথ চলে গেছে শূন্যে, স্বর্গের বেহেস্তের পথ ধরে চলে যাচ্ছেন, ছোটখাটো চেহারার, কিন্তু পর্বতের চেয়ে উঁচু, উচ্চশির ওই কবি। হিমালয়ের গিরিশৃঙ্গগুলি কি নুয়ে পড়ে তাকে বিদায় জানাচ্ছে না? জানাচ্ছে। রোদন করছে না কি অরণ্যগুলি, সমগ্র সুন্দরবন? করছে, করছে। ধানখেতগুলিতে ঢেউ তুলে ঘুরছে ক্রন্দনরত বাতাসের দল।’

আল মাহমুদ বিদায় হলেন। বাঙালিদের ভাষার আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, কোথায় ছিলেন না আল মাহমুদ? এক জীবনে এত বিচিত্রমুখী কাব্য, শিশুতোষ ছড়া, এত এত বিশাল বড় উপন্যাস, গল্পসম্ভার, ব্যতিক্রমী আত্মজীবনী কেই বা লিখেছেন? তবু নতশির না হওয়ার জন্য, আদর্শবোধের জন্য তার প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করে জাতি হিসেবে আমরা নিজেদের কতটা উচ্চতায় নিয়ে গেলাম, কে জানে।

স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ের কবিতার মধ্য দিয়েই অন্য অনেকের মতো আমারও পরিচয় এই কবির সাথে। ’৫০-এর দশকের আলোড়ন তোলা এই কবি একই সাথে ছিলেন আলোচিত সম্পাদকও। মফস্বল শহরে থাকতেই অগ্রজদের আড্ডায় তাকে নিয়ে তুমুল আলোচনা-বিতর্ক শুনতাম। সেই কবির সাথে ঢাকায় প্রথম মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয় ১৯৮৩ সালে। তিনি তখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উপপরিচালক। তার সম্পাদিত গণকণ্ঠ নিষিদ্ধ হওয়ার পর ৯ মাস কারাবরণ শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে এ চাকরিতে নিয়োগ দিয়েছিলেন। সাংবাদিকতা থেকে শিল্পকলা একাডেমির এই নতুন কর্মক্ষেত্র। এর অল্প দিনের মধ্যে রাষ্ট্রে ও সমাজে ঘটে যায় অনেক পরিবর্তন। নতুন এক অভিযাত্রা ঘটে বাংলাদেশের।

এর আগে জেলে অন্তরীণ থাকতেই আল মাহমুদের চিন্তা জগতে আসে পরিবর্তন। তার সে সময়ের কবিতায় অন্যায্য শাসন-শোষণের অবসানের আকাক্সক্ষা রয়েছে, আমূল পরিবর্তনের ডাকও রয়েছে। কিন্তু সব কিছুকে অস্বীকার করে নাস্তিক্যবাদের ডঙ্কা উড়ানোর প্রয়াস তার কবিতায় দেখা যায়নি। একপর্যায়ে, বাম ধ্যানধারণা ও দর্শনই মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায় হতে পারে- এমন বিশ্বাসে তার চিড় ধরে। আর কবির ভাবনায়, জীবনাচরণে মহাশক্তিকে আবিষ্কার এবং অনুভবের প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। তিনি অধ্যয়ন করতে শুরু করেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব। কুরআন, বাইবেল, রাসূলদের জীবনী অধ্যয়ন করেন তিনি।

এটি ব্যক্তি আল মাহমুদের জীবনে আনে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। তার মানস জগতে এই পরিবর্তন নিয়ে কবি একটি সাক্ষাৎকারে আলোকপাত করেছেন। বলেছেন, “এক সময় আমি সমাজতন্ত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলাম সত্যি, তবে ‘কাঠ নাস্তিক’ যাকে বলে, তা কখনোই ছিলাম না। গণকণ্ঠ সম্পাদনার কারণে যখন জেলে যাই তখন একটা ‘কম্পারেটিভ স্টাডির’ সুযোগ পাই। সব জেনে-বুঝে সজ্ঞানে আমি ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করি। আমি নিজেকে একজন বিশ্বাসী মুসলমান মনে করি। এটা নিয়ে আমার কোনো রাখ-ঢাক নেই। পরিষ্কার কথা। মানুষ হিসেবে আমার হয়তো হাজারো ভুল আছে; কিন্তু কুরআনই আমার সংবিধান। রাসূল সা: আমার পথপ্রদর্শক। এই বিশ্বাসের কারণে আমাকে গালমন্দ সহ্য করতে হয়েছে। আমি আনন্দিত আমার বিশ্বাসের কাছে প্রত্যাবর্তন করতে পেরে। আমার ধর্মবিশ্বাসের সাথে কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। হতে পারে আমার এই বিশ্বাসকে কেউ কাজে লাগাতে চেয়েছে। আমাকে অস্বীকার করলেও আমার কবিতাকে তো কেউ ফেলে দিতে পারবে না। সাহিত্যের গায়ে রাজনীতির পোশাক আমি কখনো পরাইনি। আমি রাজনৈতিক লোক নই, তবে এ বিষয়ে আমার সচেতনতা আছে।”

আল মাহমুদের এই পরিবর্তনে নিয়ামক হয়ে ওঠে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক দৃশ্যপটের পরিবর্তনও। এ সময় জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ঘটে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। জিয়ার আদর্শ, স্বপ্ন ও ভাবনাকে তিনি বেশ গভীর এবং খানিকটা অন্তরঙ্গভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পান। জিয়া নিজের শক্তি বলে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে টিকে থাকা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বপ্নই ছিল অন্যভাবে কবি আল মাহমুদের। দু’জনের লক্ষ্যের এই অভিন্নতা দু’টি ভিন্ন ক্ষেত্রে সৈনিকে পরিণত করে উভয়কে। একজন মাটির গভীরের রস আস্বাদনকারী স্বপ্নচারী কবি-লেখক-সাংবাদিক, অন্যজন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করা এবং দুঃসময়ে জাতির কাণ্ডারি হিসেবে আবির্ভূত, একজন রাষ্ট্রনায়ক।

পরিবর্তনের এই সময়টাতেই কবি আল মাহমুদের ব্যক্তি, পেশা এবং লেখক জীবনের ঘনিষ্ঠ অনুরক্ত হয়ে কিছু সময় পার করার সুযোগ ঘটে। সুহৃদ আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্লাহ ও বুলবুল সারওয়ারের সাথে তার অফিসে কিছু সময় কাটানো তখন আমার দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে ওঠে। রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতার প্রাত্যহিক কাজের বাইরে তখন কখনো আল মাহমুদ, কখনো সৈয়দ আলী আহসান, আবার মাঝে মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দ অথবা ফখরুজ্জামান চৌধুরীর অফিসে যাতায়াত করতে হতো। এসব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে ছিলেন ওবায়েদ ভাই, আর সাথে ছিলেন বুলবুল সারওয়ার। আমরা এই তিনজন মিলে বের করি একটি সাহিত্য পত্রিকা- ‘অঙ্গীকার’। এর অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন আল মাহমুদ। অঙ্গীকার-এর কয়েকটি সংখ্যা নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়েছিল। কিন্তু সাহিত্য পত্রিকা টেকসই হওয়ার জন্য আবেগের বাইরে যে আর্থিক ভিত্তি ও পরিণামদর্শী পরিকল্পনা থাকতে হয়, তার অভাবে এটি স্বল্প আয়ুর স্মৃতিতে পরিণত হয়।

তখন সাহিত্য পত্রিকার পাশাপাশি চিন্তা আসে সাহিত্যাশ্রয়ী সাময়িকী প্রকাশের। অগ্রজ বন্ধুপ্রতিম ব্যবসায়ী, (মরহুম) আবদুস সালামের বিশেষ আগ্রহে এ সময় প্রকাশিত হয় পাক্ষিক ‘পালাবদল’। একই সাথে ওবায়েদ ভাইয়ের বিশেষ উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক কাওসার হোসাইনকে (পরে সড়ক দুর্ঘটনায় পরলোকগত) ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করে বের হয় ‘অঙ্গীকার ডাইজেস্ট’। দু’টি পত্রিকারই উপদেষ্টা সম্পাদক হলেন আল মাহমুদ।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, একটি রেডিক্যাল বিরোধীদলীয় দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনার ঝড়ো পেশা থেকে শিল্পকলার নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তা হওয়ার স্বস্তিকর কর্মজীবন আল মাহমুদের লেখালেখিতে এক ধরনের প্রভাব ফেলেছে। এ সময় বাড়তি আয় এবং সাংবাদিকতা জীবনের ধারাবাহিকতায় তিনি নামে-বেনামে সংবাদপত্রে কলাম লিখতে থাকেন। কাব্যচর্চাও চলে সমানভাবে। সেই সাথে ভিন্নধর্মী আত্মজীবনী, গল্পগ্রন্থ, উপন্যাস- এসব আলোচিত লেখা সৃষ্টি হয় ওই সময়টাতে। একটি দৈনিকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় কবির আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’।

অগ্রজ সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক সাজ্জাদ হোসাইন খানের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল কবির এ বই লেখার ক্ষেত্রে। এরপর আমরা নতুন ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশ করি, আল মাহমুদের বহুল আলোচিত মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’। কবির পরবর্তী জীবনভিত্তিক গ্রন্থ বা উপন্যাস লেখার জন্যও আমরা উৎসাহিত করেছি, বলা যায় কবিকে নানাভাবে উত্তেজিত করার চেষ্টা করতাম। মাহমুদ ভাই কোনো সময় আমাদের ‘না’ বলতেন না। সব সময় আশ্বস্ত করেছেন লিখবেন বলে। অবশেষে সত্যি সত্যিই তিনি রাজি হলেন। কিন্তু পালাবদলে প্রথমে শুরু করলেন ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস ‘ডাহুকি’। কবিরা যখন কথাসাহিত্য লেখেন তখন কোনো কোনো সময় পড়ে মনে হয় না, তিনি একজন কবি। আবার অনেকের গল্প-উপন্যাসের একেকটি অংশ হয়ে ওঠে কবিতা। ‘দিনযাপন’-এর মতো অসাধারণ এক প্রবন্ধের বই আর ‘ডাহুকি’ পড়লেও কাউকে বলতে হবে না, এই উপন্যাস লিখেছেন একজন খ্যাতিমান কবি। ডাহুকি শেষ হওয়ার পর আরেকটি বড় ক্যানভাসের উপন্যাস লেখার জন্য প্ররোচিত করতে থাকি কবিকে।

শেষ পর্যন্ত তিনি ‘কাবিলের বোন’ নামের এই উপন্যাস শুরু এবং শেষ করেন। এর পর শুরু করেন নতুন উপন্যাস ‘যে পারো ভুলিয়ে দাও’। আমরা চাইছিলাম ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ দিয়ে কবি নিজেকে যেভাবে তুলে ধরেছিলেন সেটি পরিণতি লাভ করুক। কিন্তু পালাবদলে আমি আর কাজ না করার কারণে মাহমুদ ভাইয়ের কাছ থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে এ উপন্যাসটি আদায় করতে পারিনি। এটি থেকে যায় একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাসের প্রারম্ভিক অধ্যায়ের মতো। কবি ‘অঙ্গীকারে’ লিখেছিলেন আরেকটি উপন্যাস ‘মরু মূষিকের উপত্যকা’।

পাক্ষিক পালাবদলের অফিস তখন ফকিরাপুলে। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিকভাবে এর সাথে ইসলামী ব্যাংকের দীর্ঘ সময়ের সাবেক চেয়ারম্যান কমোডর আতাউর রহমান, বাংলাদেশ টাইমস ও টেলিগ্রাফের সিনিয়র সাংবাদিক ফিরোজ আহমদ, ফটো সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাক, বন্ধু সাংবাদিক হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী, অনুজ প্রতিম ডা: আবু হেনা আবিদ জাফর, প্রতিভাবান কবি শাকিল রিয়াজ, এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এস এস মিলন ইসলাম, রফিকুল ইসলাম আজাদ ও মুহাম্মদ ইকরাম যুক্ত ছিলেন। পত্রিকার নিয়মিত মাসিক সভায় যোগ দিতেন শিক্ষাবিদ পণ্ডিত কবি জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ, কথাশিল্পী অনুবাদক ফখরুজ্জামান চৌধুরী, কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ, কথাশিল্পী আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দীন, শিক্ষাবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী, নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ, গীতিকার অধ্যাপক আবু জাফর, সাহিত্যিক জুবাইদা গুলশান আরা, শাহাবুদ্দিন নাগরী, ড. তারেক শামসুর রেহমানসহ আরো অনেকে। আল মাহমুদ ছিলেন এসব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি।

ফকিরাপুলের অপরিসর পালাবদল অফিসের একটি কক্ষ ছিল আল মাহমুদের লেখালেখির জন্য সংরক্ষিত। এখানে বসেই তিনি লিখেছেন অনন্য সাধারণ উপন্যাস ‘ডাহুকি’। বাংলা কথাসাহিত্যে বহু বছর ধরে আলোচনা হওয়ার মতো দীর্ঘ উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ও লিখেছেন এখানে বসেই। নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট, পালাবদল এবং অঙ্গীকার ডাইজেস্টের এই পাঁচ-সাত বছর সম্ভবত ছিল আল মাহমুদের লেখক জীবনের সবচেয়ে বেশি ‘উৎপাদনশীল’ সময়।

তিরিশ-উত্তর বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের ছিল একটি বিশিষ্ট স্থান। ১৯৫৪ সালে ঢাকা আসার আগেই তার কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার সাহিত্য, চতুষ্কোণ, চতুরঙ্গ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাসে। আধুনিক বাংলা কবিতায় তিনি ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহকে তুলে এনেছেন। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের চমৎকার প্রয়োগে আল মাহমুদ কাব্যরসিকদের মধ্যে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধারার এক নতুন কবিপ্রতিভা হিসেবে চিহ্নিত হন তিনি। কবি নিজেই বলেছেন, ‘আমরা ছিলাম বাংলা ভাষার প্রথম বাঙালি লেখক। তিরিশ-উত্তর বাংলা কবিতায় রূপ, দেশভাগ, মানুষ চলে যাচ্ছে, দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া- এ রকম একটা সময় আমাদের বুকের ওপর দিয়ে গেছে। ভ্রাতৃহত্যা, দুর্ভিক্ষ, মানুষ মরে পড়ে আছে রাস্তায়, জয়নুল আবেদিনের ছবি, কাক মানুষকে ঠোকরাচ্ছে- এ দৃশ্যগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছি। এ জন্য পঞ্চাশের লেখকেরা যারা ষাট দশকে লিখেছেন, তাদের ভেতর স্বপ্ন নেই, ড্রিমটা কম। তারপর এই অপূর্ণতা পূরণ করার চেষ্টা করা হলেও আমরা বাস্তবের সঙ্ঘাতে বড় হয়েছি।’

১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় কাব্য ‘কালের কলস’। এ দু’টি কাব্যের ভেতর দিয়ে তিনি নিজেকে প্রকাশ করেন সম্পূর্ণ মৌলিক ও নিজস্ব ঘরানার কবি হিসেবে। তার তৃতীয় কাব্য ‘সোনালী কাবিন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে। সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসে চট্টগ্রামে থাকাবস্থায় লেখা, ‘সোনালী কাবিন’ একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এরপর আল মাহমুদের কবিতা একটি ভিন্ন বাঁক নেয় ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র ভেতর দিয়ে। মূলত আল মাহমুদের আদর্শগত চেতনারও পরিবর্তন ঘটে এ সময়। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ এবং ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্নায়’ কবির ইসলামের প্রতি গভীর অনুরক্তির প্রকাশ ঘটে। পরবর্তীকালে প্রহরান্তের পাশ ফেরা, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া প্রভৃতি কাব্যেও তিনি এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘দ্বিতীয় ভাঙন’-এ কবি আরো একবার নিজেকে পরিবর্তন করেছেন, ভেঙেছেন।

কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যে আল মাহমুদের আবির্ভাব এ দেশের গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বলা যায়, তার সাহিত্যজীবন শুরুই হয়েছিল গল্প দিয়ে। ১৯৫৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘সত্যযুগ’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। তারপর দীর্ঘ দিন গল্প লেখায় বিরতি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’ সম্পাদনার সময় তিনি বেশ কিছু গল্প লিখেছিলেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রিকায় তার পানকৌড়ির রক্ত, কালোনৌকা, জলবেশ্যা প্রভৃতি গল্প প্রকাশ পায়। ১৯৭৫-এ তার প্রথম ছোটগল্পের সঙ্কলন ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয় এবং বিপুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। আল মাহমুদের পরবর্তী গল্পগ্রন্থ ছিল ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’। এর পর তিনি গন্ধবণিক ও ময়ূরীর মুখসহ দশটির মতো গল্পগ্রন্থ লিখেছেন।

তার লেখা উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’ ছিল প্রত্যক্ষ ও বিস্মৃত প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকে ধরার প্রয়াস। অন্য দিকে, ‘কাবিলের বোন’ শেষ পর্যায়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হলেও এর প্রধান অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও চলাকালীন বাংলাদেশে অবস্থানরত ‘বিহারিদের’ অস্তিত্ব বিপর্যয়ের কাহিনী। সন্দেহ নেই, ‘কাবিলের বোন’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনালোচিত অধ্যায়ের শব্দরূপ। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং শেষের দিকটা এসেছে ‘কাবিলের বোন’-এ। মাঝখানটা জুড়ে রয়েছে ‘উপমহাদেশ’। এ দুই উপন্যাস মিলে মুক্তিযুদ্ধের এক সম্পূর্ণ কাহিনী।

আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ কবি যখন লেখেন অনেকের মধ্যে প্রশ্ন ছিল- এটি কি আত্মজীবনী নাকি উপন্যাস? এখানে কবি নিজের বেড়ে ওঠার কাহিনী বর্ণনা করেছেন; কিন্তু ঢং ছিল না; নিজ জীবনের গতানুগতিক বর্ণনা। কবি বলেছেন- ‘যারা আমার ভক্ত তারা এই বইটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আর যারা আমার সহযাত্রী কবি বন্ধু এবং সমান বয়সী তাদের বক্তব্য হলো পঞ্চাশ দশকে কবিদের একটাই আত্মজীবনী, আর তা হলো- ‘যেভাবে বেড়ে উঠি।’

‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র পর কবির জীবনের পরবর্তী অধ্যায় নিয়ে লিখতে আমরা প্রায়ই উত্ত্যক্ত করতাম। এক সময় রাজিও হলেন। ঢাকা ডাইজেস্টে ধারাবাহিকভাবে লেখা শুরু করলেন ‘উপমহাদেশ’। ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র মতো উত্তম পুরুষে লেখা হয়নি এটি। ঢং গতানুগতিক উপন্যাসের মতো। কিন্তু উপন্যাসের নায়ক যে কবি নিজেই, সেই আন্দাজ আমরা করতাম। কবি কখনো তা অস্বীকার করেননি।

আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে কত বড় একজন ব্যক্তি, তা যারা তার সান্নিধ্যে এসেছেন তারা বুঝতে পারবেন না। এক অদ্ভুত সরলতা ছিল তার জীবনযাপনে। এত বড় কবি নিঃসঙ্কোচে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে গেছেন কোনো অনুষ্ঠানে অথবা ফিরেছেন বাসায়। সংসারের পুরো ভার স্ত্রী নাদিরা মাহমুদের ওপর দিয়ে তিনি ছিলেন নিশ্চিন্ত। নিজের আয়ের পুরোটা তিনি তুলে দিতেন; আর সংসারের সব কিছু করতেন দীর্ঘকায় সহধর্মিণী। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের পড়াশোনা আর বিয়ে এবং তাদের সংসারের সব কিছু সামাল দিতেন তিনিই।

শেষ দিকে এসে কবির সাথে ঘন ঘন সাক্ষাতের সুযোগ হতো না। বছরখানেকের জন্য আমি মালয়েশিয়াতে ছিলাম। সেখান থেকে আসার পর সুহৃদ অ্যাডভোকেট সালেহ উদ্দিনসহ কবিকে দেখার জন্য মগবাজারের বাসায় যাই। বাবা-মা আমার নামের প্রথম শব্দ দিয়ে যেভাবে ডাকতেন, সব সময় সেই নামই শুনতাম আল মাহমুদ ভাইয়ের কাছে। এবার দেখে ঠিকমতো পরখ করতে পারলেন না। তখন তিনি অনেকখানি দৃষ্টিহীন শীর্ণকায়। আমার কণ্ঠ শুনে তিনি চিনে নেন। বেশ কিছু সময় সেদিন কথা হয়েছিল। এর পর তার লেখালেখি এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। জীবনের শেষের দিকটাতে তিনি বারবার মৃত্যুর কথাই বলতেন। অন্য কবি ‘যেখানে মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’ লিখেছেন। সেখানে মৃৃত্যুর মাঝে আল মাহমুদ খুঁজে পেয়েছেন ঈদ।

কবির উচ্চারণটা ঠিক এ রকম- “আলহামদুলিল্লাহ। জীবনের কাছে আমি তৃপ্ত। পূর্ণতা না থাকলেও শূন্যতা নেই। অপ্রাপ্তিও হয়তো নেই। আমি মুগ্ধ, আনন্দিত। তবে আমি এখনো ভাবি জীবন নিয়ে, জগৎ নিয়ে। ভাবি, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাবো। আমি চিন্তা করি। চিন্তার ভেতর দিয়েই আমি আল মাহমুদ। লিখতে পেরেছি। আরো অবশ্য লিখতে ইচ্ছে হয় অনেক- অনেক কিছু। কিন্তু এত শক্তি-সামর্থ্য কিংবা আয়ু কোথায় আমার? আল্লাহ চিন্তাশীলদের পছন্দ করেন- তাই চিন্তা করতে ভালো লাগে। পেছন অতীতের কথা চিন্তা করি। অনেক মুখ মনে পড়ে। ফিরে যাই পেছনে। ভাবতে ভাবতে ফিরে যাই কৈশোরে। মায়ের আঁচল ধরে যেন অলক্ষ্যে বলে উঠি- বাড়ি যাবো। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার বাড়ি কই, আমার বাড়ি কি কখনো ছিল? জীবনে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, তা যেন ফুরোবার নয়। আমি কৃতজ্ঞ এই মা, মাটি আর মানুষের কাছে। আমি আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকি। আর এরই মধ্যে তোমরা একদিন শুনবে ‘আল মাহমুদ আর নেই’।”

জীবনের সর্বশেষ টিভি সাক্ষাৎকারেও সেই অভিব্যক্তিই উচ্চারিত হয়েছে। ডিটিভির সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মৃত্যুর পরে জীবন আছে। সেই জীবনে আমি থাকব। হ্যাঁ, স্বস্তিকর জীবন। শান্তির জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আমি ভালো যা করেছি তার জন্য সেখানে আমি পুরস্কৃৃত হবো। আর মন্দ যা করেছি, তার জন্য আল্লাহ যদি মাফ করে দেন, তাহলে তো আর কোনো কথা নেই।’

আল মাহমুদ এখন ‘লোক’ থেকে অনেক দূরে। শেষটাতে ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর কথাটিই বলব, ‘আল মাহমুদের কাছে বাংলা কবিতা ঋণী, ঋণী পূর্ববঙ্গের কবিতা; ঋণী বাংলা ভাষা। কবি আল মাহমুদ প্রসঙ্গে এটিই শেষ কথা।’

mrkmmb@gmail.com

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top