এসএসসি পাস করেই ফাহমিদা যেভাবে এমবিবিএস, এফসিপিএস

নারায়ণগঞ্জে ভুয়া ডাক্তারের হাতে প্রতারিত হচ্ছে স্থানীয় জনগণ। অনুমোদন ছাড়াই গড়ে ওঠা বিভিন্ন হাসপাতাল, ক্লিনিকে এরা বড় বড় ডিগ্রি লাগিয়ে রোগীদের সাথে প্রতারণা করছেন। গত কিছু দিনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের হাতে এমন বেশ কিছু ভুয়া ডাক্তার গ্রেফতার হয়েছেন। সিলগালাও করে দেয়া হচ্ছে দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারপরও এদের দৌরাত্ম্য কমছে না।

২০০১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি ও ২০০৯ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি পাস করেন তানভির আহমেদ সরকার। এরপর হঠাৎ করেই তিনি ডাক্তার বনে যান। নিজের নামের শেষে এমবিবিএস ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ জুড়ে দেন। বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ও আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে তার পরিচয় ডা: মো: তানভীর আহমেদ সরকার, সনোলজিস্ট উল্লেখ আছে। এছাড়া রোগীদের প্রেসক্রিপশনেও ভিন্ন ভিন্ন নামে তিনি নিজেই সই করতেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি এ ভুয়া ডাক্তারের।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার সানারপাড় রহিম মার্কেটের হেলথ কেয়ার আধুনিক হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী দেখার সময় গত ৮ মে রাতে র্যাব তাকে গ্রেফতার করে। ওই হাসপাতালের ভবন মালিক সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমানের হওয়ায় ভুয়া ডাক্তার আর হাসপাতালের মালিকেরা ছিল বেপরোয়া। ভুয়া ডাক্তার তানভির আহমেদ সরকারকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং হাসপাতালের ম্যানেজার আবুল বাশারকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন র্যাব সদর দফতর ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো: সরোয়ার আলম। এ সময় ওই বেসরকারি হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয়া হয়।

র্যাব জানায়, তানভীর আহমেদ কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার শিবনগর এলাকার আব্দুল মতিন চৌধুরীর ছেলে। তিনি দীর্ঘ দিন ধরে নিজেকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিয়ে ওই হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখতেন। আসলে সে একজন ভুয়া ডাক্তার।

তানভীর আহমেদ সরকারের মতো আরো দুজন ভুয়া ডাক্তারকে সম্প্রতি কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ডেন্টাল ক্লিনিকগুলোতে ভুয়া ডাক্তারের ছড়াছড়ি। দিন দিন ভুয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। চিকিৎসক হওয়ার সনদ না থাকলেও অনেকেই নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে রোগীদের সাথে প্রতারণা করে আসছে। এসব ভুয়া চিকিৎসকের খপ্পরে পড়ে অনেক রোগীর জীবন হয়ে উঠছে সঙ্কটাপন্ন।

সম্প্রতি সিদ্ধিরগঞ্জে তিনজন ভুয়া চিকিৎসককে আটক করে সাজা প্রদান করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। গত ২ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ফ্যামিলি ল্যাব হসপিটাল নামের একটি ক্লিনিকে র্যাবের অভিযানে ভুয়া ডাক্তার নজরুল ইসলাম শেখকে ১ বছরের কারাদন্ড প্রদান করে ভ্রাম্যমান আদালত। ওই ভুয়া ডাক্তারের নামের পাশে ডিগ্রী হিসেবে লেখা ছিল এমবিবিএস, সনোলজিস্ট। নিজেকে অভিজ্ঞ ডাক্তার পরিচয়েই দিয়ে ২ বছর যাবত প্রতারণা করে আসছিলেন রোগীদের সাথে।

এর আগে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এলাকার এম হোসেন জেনারেল হসপিটাল নামের হাসপাতালে র্যাবের অভিযানে আটক ভুয়া ডাক্তার ফাহমিদা আলমকে ৬ মাসের জেল ও হাসপাতালটি সীলগালা করে দেয়া হয়। নিজেকে অভিজ্ঞ ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ফাহমিদা আলম দিনে পর দিন প্রতারণা করে আসছিলেন রোগীদের সাথে। অথচ ফাহমিদা ছিলেন মাত্র এসএসসি পাস। তবে প্রেসক্রিপশনে তার নামের পাশে পদবির ডিগ্রি হিসেবে লেখা থাকত এমবিবিএস, এফসিপিএস।

র্যাব-১১-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন জানান, সিদ্ধিরগঞ্জের কদমতলী এম হোসেন জেনারেল হাসপাতাল থেকে আটক ফাহমিদার নামের পাশে ডিগ্রি হিসেবে লেখা ছিল ‘এমবিবিএস, এফসিপিএস’। নিজেকে অভিজ্ঞ ডাক্তার পরিচয়েই দিনে পর দিন তিনি রোগীদের সাথে প্রতারণা করে আসছিলেন। ডাক্তার পরিচয় দিলেও দেখাতে পারেননি কোনো সনদপত্র। তিনি যে হাসপাতালে বসেন সেই হাসপাতালেরও নেই প্রয়োজনীয় কোনো নথিপত্র।

২০১৮ সালের ১৪ মার্চ শহরের খানপুরে অবস্থিত ইউনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে এস এম জালাল নামের ভুয়া ডাক্তারকে আটক করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তিনি ডাক্তার না হয়েও এমবিবিএস পরিচয় দিয়ে রোগীদের আল্টাসনোগ্রাম করাচ্ছিলেন। পরে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
এর আগে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল চৌধুরীবাড়ী বাসস্ট্যান্ডস্থ জনস্বাস্থ্য জেনারেল হাসপাতালে মোবারক ইসলাম নামের এক ভুয়া ডাক্তারকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় ভুয়া ডাক্তার মোবারক ইসলামের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল পরিমাণ জাল সার্টিফিকেট ও সার্টিফিকেট তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত ওই হাসপাতালটিকে সিলগালা করে দেন।

এছাড়া স্কুলের গণ্ডি না পেরুলেও দিব্যি সাইনবোর্ডে চিকিৎসক উপাধি লিখে তিন বছর ধরে রোগীদের চিকিৎসার নামে প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন মাহফুজ চৌধুরী। কয়েক বছর আগে হাতেনাতে সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল চৌধুরী বাড়িস্থ সুলতান সুপার মার্কেটে চৌধুরী ডেন্টাল কেয়ার নামের একটি ভুয়া দন্ত চিকিৎসালয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পাস করা মাহফুজকে আটক করে সম্প্রতি দুই মাসের কারাদণ্ড দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুমানা ইয়াসমিনের নেতৃত্বাধীন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে গৌরি চাঁদ পণ্ডিত ওরফে সুবির নামের একজন ভুয়া ডাক্তারকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ন্যাশনাল মেডিক্যাল সেন্টারে ওই অভিযান চালায় র্যাব-১১ সদস্যরা। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও নারায়ণগঞ্জ সদরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাসুম আলী বেগের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ওই সাজা দেয়া হয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top