একজন ক্লিন ইমেজের মেয়র আনিসুল হক : প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

মো. আব্দুল কাইয়ুম : একজন ক্লিন ইমেজের মেয়র তিনি। তার প্রতি কারো নেই কোন অভিযোগ অনুযোগ। দলমত নির্বিশেষে একজন সফল মেয়র ছিলেন তিনি। সেবার কাছেই ছিলেন একজন ভালো মনের মানুষ। তিনিই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আনিসুল হক।

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়, কখনো কখনো স্বপ্নের চেয়েও বড়- কথাটি বিভিন্ন মঞ্চে বারবার প্রচার করেছেন আনিসুল হক। তিনি বলতেন, মানুষ সংঘবদ্ধ হলে পৃথিবী বদলে যেতে পারে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র এভাবেই তরুণদের স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন সবুজে ভরা সুন্দর একটি ঢাকা গড়ার। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার অকাল মৃত্যুতে স্বপ্নের সেই ঢাকা আজও অধরা। বহু উন্নয়ন কাজ শুরু করলেও তা শেষ করে যেতে পারেননি তিনি।

আনিসুল হক ২০১৫ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র নির্বাচিত হন। রাজধানীকে পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও ‘স্মার্ট’ নগরী হিসাবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোচিত ও প্রশংসিত হন তিনি।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালের সামনের সড়ক দখলমুক্ত করতে গিয়ে বিক্ষুব্ধ চালকদের ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। পরে ওই সড়ক দখলমুক্ত করেন তিনি।

নগরবাসীর কাছে ঢাকার আকাশ এক রকম অবরুদ্ধ হয়েছিল। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই তিনি ঢাকা শহর থেকে সব বিলবোর্ড উচ্ছেদ করে আকাশকে খুলে দেন। যা একসময় কেউ চিন্তাও করতে পারেনি।

শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবহনের যানবাহনে রাস্তার দখল ছিল। ফলে দীর্ঘ সময় যানজটে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হতো। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ঘোষণা দিয়েই তিনি শ্যামলী থেকে গাবতলী পর্যন্ত রাস্তাকে গতিময় করে তোলেন।

বিভিন্ন এলাকার পার্কগুলো দখলদারদের কাছে চলে গিয়েছিল। আনিসুল হক একের পর এক সেসব পার্ক দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করেন। শহরের পথচারীদের জন্য আধুনিক টয়লেট নির্মাণ করেন। এজন্য মানুষের আস্থার জায়গা তৈরি হয় আনিসুল হককে ঘিরে।

গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতন এলাকায় বিশেষ রঙের রিকশা এবং ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা চালু করেন আনিসুল হক। বিমানবন্দর সড়কে যানজট কমাতে মহাখালী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে ইউলুপ করার উদ্যোগ নেন তিনি।

১৯৮৬ সালে আনিসুল হক তার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘মোহাম্মদী গ্রুপ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুলের তৈরি পোশাক ছাড়া বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা রয়েছে। ডিজি জাদু ব্রডব্যান্ড লিমিটেড এবং নাগরিক টেলিভিশনের মালিকানাও তার ব্যবসায়ী গ্রুপের।

স্মার্ট ছিমছাম:

‘স্মার্ট মেয়র’ উপমা তাঁর জন্যই প্রযোজ্য ছিল। চালচলনে, কথাবার্তা, আচরণ কিংবা ফ্যাশনে সবকিছুতে তাঁর রুচির ছাপ। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ছিমছাম সাদামাটা থাকতেই পছন্দ করতেন। যদিও মেয়র হওয়ার পর স্ত্রী রুবানা হক বলতেন কিছুটা ফরমাল পোশাক পরতে। সেটি মেনে খুব ফরমাল কোনো অনুষ্ঠান স্যুট পরতেন। স্যুট পরলেও টাই পরা একদমই পছন্দ ছিল না। পাঞ্জাবি আর টি-শার্টই বেশি পরা হতো তাঁর। প্রাণোচ্ছল এই মানুষের প্রিয় রং গাঢ় নীল। ঘিয়া ও কালো রংও পরতেন মাঝেমধ্যে।

একজন সফল অভিবাবক:

‘গুড টাইমিং’ বলে একটা বিষয় আনিসুল হকের জীবনে সব সময়ই ঘটেছে। সে জন্য ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস ছিল তাঁর। বড় মেয়ের বিয়েতে কত আনন্দ করেছিলেন, ছেলে নাভিদ খুব দায়িত্ববান, স্ত্রী রুবানা হকের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম-ভালোবাসা, বিয়ে সবই তিনি বলেছিলেন সেদিনের সন্ধ্যায়। আনিসুল হক বলছিলেন, ‘আমার সংসার-জীবন সব সহজ হয়েছে রুবানার কারণে। ওর থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। কোনো কিছুতে হাল ছাড়ে না। ঠান্ডা মাথায় সব সামলাতে পারে।’ স্ত্রীর প্রতিও তাঁর ভালোবাসার প্রগাঢ়তা ঢের ছিল।

একজন ধৈর্যশীল ব্যক্তি:

মা-বাবা ও ভাইদের কাছে খুব কৃতজ্ঞ তিনি। কতবার ব্যবসা করার জন্য টাকা নিয়েছেন। একবার ঢাকার বাইরে গেলেন পাট কিনতে। পাট কিনে ফেরার সময় ট্রাকচালক ফন্দি করে আনিসুল হককে প্রহার করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। সেবার তাঁর মনে হয়েছিল, এ জীবনে কিছু হবে না। কিন্তু আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। কোনো কিছুতে সহজে দমে যেতেন না।

১৯৫২ সালের ২৭ অক্টোবর নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন আনিসুল হক। শৈশব কেটেছে নানাবাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। আশির দশকে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে জনপ্রিয়তা পান আনিসুল হক। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পূর্বে বিটিভিতে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুখোমুখি একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি। ২০০৫-০৬ সালে বিজিএমইএর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৮ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হন। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সংগঠন সার্ক চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। ব্যবসায়ী আনিসুল হক ২০১৫ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র নির্বাচিত হন।

মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরে ঢাকাবাসীর জন্য তিনি নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সড়ক দখলমুক্ত করা, যানজট কমানো, মশা নিধনসহ রাজধানীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে তাঁর ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top