আগুনে দুই সন্তান হারানো বৃদ্ধ পিতার আকুতি

সাহেব উল্লাহ, বয়স ৭০ এর কাছাকাছি। তার দুই ছেলে রানা আর রাজু- ব্যবসা করতো চকবাজারের চুরিহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানসনের নিচ তলায়। এমআর টেলিকম নামে একটি দোকান ছিলো তাদের। ছোট ছেলে মিরাজ এখনো পড়াশোনা করছে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুরিহাট্টার ভয়াবহ আগুনে নিভে গেছে সাহেব উল্লাহর ঘরের আলো। উপার্জনক্ষম দুই সন্তানকে হারিয়ে চারদিকে এখন শুধুই অন্ধকার দেখছেন এই বৃদ্ধ। সরকারি বা বেসরকারি যেকোনভাবেই একমাত্র ভরসা ছোট ছেলে মিরাজের কাজের কোন সুরাহা না হলে অল্প দিনের মধ্যেই পথে বসতে হবে এক সময়ের স্বচ্ছল এই পুরো পরিবারটিকে।

আদরের দুই সন্তান হারিয়ে নির্বাক সাহেব উল্লাহ। রানা আর রাজুর মাও মুর্ছা যাচ্ছেন বারবার। মাসুদ রানার চার বছরের ছেলে মোহাম্মদ শামছুল আরেফীন। বাবা আর চাচ্চু যে মারা গেছে তা এখনো বুঝতেই পারছে না সে। হেসে খেলে সময় পার করছে। বাবা আর চাচ্চুকে খুঁজে বেড়ায় এ ঘর, ঐ ঘর। গভীর রাত অবধি বাবার অপেক্ষায় থাকে।

আর ওই অগ্নিকাণ্ডের মাত্র ২৮ দিন আগে বিয়ে করেছিল মাহবুবুর রহমান রাজু। নতুন বউয়ের হাতের মেহেদীর রঙ এখনো শুকায়নি। এক অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হলো এই পরিবারের। চুরিহাট্টায় প্রত্যেকের কাছেই পরিচিতি মুখ ছিল রানা আর রাজু। শোক আর শ্রদ্ধায় দুই ভাইয়ের দুটি ছবি এখনো এলাকাবাসী ঝুলিয়ে রেখেছেন তাদের পুড়ে যাওয়া ভবনের দোকানের সামনে। সবাই এসে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে স্মৃতিচারণ করছেন। অনেকের গাল বেয়ে পড়ছে বেদনার অশ্রু।

কিন্তু শোকের মাঝেও সংসার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে বাবা সাহেব উল্লাহকে। দু’মাস আগেও দুই সন্তান উপার্জন করতেন । সেই অর্থে চলতো পুরো সংসার। স্বাচ্ছন্দেই দিন কাটছিল তাদের; কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই ধ্বংস করেনি, সেই সাথে গোটা পরিবারটিকে ফেলে দিয়েছে এক অনিশ্চয়তর মাঝে। আগুনে নিহত রানা-রাজুর বাবা এর আগেও কয়েকবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন, তার ছোট ছেলে খলিলুর রহমানের মিরাজের একটা কাজের ব্যবস্থা করার। মিরাজ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি করেছে। আরো পড়াশোনা করার ইচ্ছা তার থাকলেও এখন তো পরিবারের হাল তাকেই ধরতে হবে। বাবার পাশাপাশি তারও একই চাওয়া, একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে বেঁচে যাবে পুরো পরিবারটি। হোক সরকারি কিংবা বেসরকারি। কাজের একটা সংস্থান হলেই হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে একসময়ের স্বচ্ছল কিন্তু বর্তমানে নিঃস্ব এই পরিবারটি।

সাহেব উল্লাহর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালির সোনাইমুড়ির নাটেশ্বরে। এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় বর্ণনা দিলেন কিভাবে দুই ছেলেকে কাঁধে করে নিয়ে কবরে রেখেছেন। দু’গাল বেয়ে পড়ছিল অশ্রু। একসময় কণ্ঠ ধরে আসে সাহেব উল্লাহর। ডুকরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধ। সময়ে পেলেই ওয়াহেদ ম্যানসনের সামনে এসে দুই ছেলের দোকানের কাছে ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। লোকজনের সাথে ছেলেদের স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন। জানান এখানে এলে নাকি তার বুকটা অনেকটা হাল্কা লাগে।

কলিজার দুই টুকরাকে হারিয়ে শরীরও নাকি আর কথা শোনে না সাহেব উল্লাহর। বললেন, হাঁটতে গেলে পা উঠে না। চোখে সবকিছুই যেন ঝাঁপসা লাগে। সব ঘর আমার ফাঁকা। দুই ছেলের শুন্যতায় চারদিকে শুধুই হাহাকার। এর পরেও আমাদের পরিবারকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর্থিক কোন সহযোগিতা চাই না। আমরা চাই ছোট ছেলেকে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে উপযুক্ত একটি চাকুরির ব্যবস্থা করা হোক। সরকারতো অনেক জায়গাতেই অনেক কিছু করছে। এতটুকু সহযোগিতায় যদি আমাদের একটি পরিবার বেঁচে যেতে পারে তাতেই সন্তুষ্ট।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top