আইলার ১১ বছর পর সেই মে মাসেই আমফান

প্রচণ্ড শক্তি সঞ্চয় করে উপকূলের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। গত বছরের ৯ নভেম্বরও এভাবে এসেছিল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। এরও আগে ২০০৯ সালের ২৫ মে এসেছিল সর্বনাশা আইলা। তার ১১ বছর পর সেই মে মাসের ২০ তারিখ রাতে আসছে আমফান। আবহাওয়া অধিদপ্তর এরই মধ্যে মোংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আমফানের প্রভাবে এখন বৈরি আবহাওয়া বিরাজ করছে খুলনাজুড়ে। বৃষ্টির সাথে বইছে দমকা হাওয়া। বিভিন্ন এলাকায় ক্ষণে ক্ষণে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। সময় যত যাচ্ছে ততই বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। নদীতে বাড়ছে জোয়ারের পানি এবং উত্তাল অবস্থা বিরাজ করছে। মোংলা বন্দরসহ আশপাশের নদীর নৌযানগুলো নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে। কয়রা উপজেলার কয়রা সদর, উত্তর বেদকাশী এবং দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের কয়েক জায়গা দিয়ে বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। স্থানীয় মানুষজন বাঁধের ওপর মাটি দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন।

তবে আজকের আমাবশ্যার জোয়ারে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় লোকজন। সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলাসহ আশপাশের অঞ্চলে বয়ে চলেছে দমকা হাওয়া, হচ্ছে বৃষ্টিপাত। স্থানীয় নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট উচ্চতায় বয়ে চলেছে।

খুলনা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ মো. আমিরুল আজাদ বলেন, ‘মঙ্গলবার দুপুর ১টা থেকে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ সুন্দরবনের কাছ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।’

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবিলার জন্য খুলনায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৩৪৯টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র। এছাড়াও জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় যেসব পাকা ভবন ও স্কুল-কলেজ ভবন রয়েছে সেগুলোকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয় নিতে পারবেন প্রায় ৫ লাখ মানুষ। খুলনা সিভিল সার্জন অফিস ৯ উপজেলায় ১১৬টি মেডিকেল টিম গঠন করেছে। প্রয়োজন হলে তারা চিকিৎসা ও পরামর্শ দেবেন। লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে মাইকিং চলছে।

মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক জোয়ার্দার বলেন, ‘মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে কাজ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন। একই সাথে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করবেন তাদের দুই বেলা খাবার দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা কেন্দ্রগুলোতে খিচুড়ির ব্যবস্থা করেছেন।’ একই সাথে জেলা প্রশাসনের ১ হাজার ৪৬০ জন স্বেচ্ছাসেবী মানুষের সহযোগিতায় কাজ করছে বলে তিনি জানান।

এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে যে আম্পান উপকূলে আঘাত হানার এক দিন আগেই খুলনার নদ-নদীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। রূপসা নদীতে গতকাল পানির সীমা ছিল ২ দশমিক ৫২ মিটার। পশুর নদীতে পানি প্রবাহের মাত্রা ছিল ২ দশমিক ৭৯ মিটার। এ নদীর স্বাভাবিক মাত্রা ২ দশমিক ৪৪ মিটার। কয়রার হরিণখোলার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামটির মানুষ উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। তারা আশঙ্কা করছেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানলে গ্রামের সামনের ছোট্ট বেড়িবাঁধটি ভেঙে যেতে পারে। আর সেটি হলে লোনা পানিতে পুরো এলাকা ভেসে যাবে। রশি দিয়ে শক্ত করে ঘরবাড়ি বেঁধে রাখার চেষ্টা করছেন তারা। অনেকে গরু-ছাগল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে গেছেন।

হরিণখোলার আব্দুল হাকিম শেখ বলেন, ‘১১ বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আইলায় এখানে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। সে স্মৃতি এখনও মানুষের মনে গেঁথে আছে। তাই প্রত্যেকে আতঙ্কের মধ্যে আছেন।’

কয়রা সদরের ৯ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, দুপুরের জোয়ারে বেদকাশীর কাটকাটা গ্রামের পাশ দিয়ে বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে। পরে লোকজন মাটি দিয়ে পানি আটকায়। তবে জলোচ্ছ্বাস আসলে এ বাঁধ টিকবে না বলে তিনি জানান। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, কয়রা বাদে অন্যান্য উপজেলার বেড়িবাঁধ অতটা নাজুক নয়।
জলোচ্ছ্বাস না হলে বাঁধে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। গেল জোয়ারে নদীতে পানি বেড়েছে। তবে এর থেকে বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা কম বলে তিনি জানান।

কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা বলেন, ‘আমফানের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও সিপিপিসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকরা ঘূর্ণিঝড়ের বিষয়ে সতকর্তামূলত প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ১২টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। উপজেলাজুড়ে ১১৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, বিভিন্ন বিদ্যালয়ভবনসহ পাকা ও নিরাপদ স্থাপনা প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়ের জন্য। পাশাপাশি সাতটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও থানা পুলিশকে নিয়ে আলাদা টিম গঠন করা হয়েছে। নিরাপদ পানি ও খাদ্য মজুত করা হয়েছে।’

আমফানের প্রভাবে মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ: মোংলা সমুদ্রবন্দরে পণ্য বোঝাই-খালাস ও পরিবহনের কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘এলার্ট-৩’ জারি করেছে। বন্দরে মোট ১১টি বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজ অবস্থান করছে।

বন্দরের হারবার মাস্টার কমান্ডার ফখর উদ্দিন জানান, ঘূর্ণিঝড় আমফানের কারণে জরুরি কন্ট্রোল রুম খুলেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সম্ভাব্য ঝড় মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া অবস্থা বুঝে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরও জানান, সংকেত বাড়ার সাথে সাথে জাহাজের পাশে থাকা সব লাইটার জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

সূত্র : ইউএনবি

Share this post

scroll to top