‘৫৩ পরামর্শককে ১৬০ কোটি টাকা সম্মানী দেয়া অস্বাভাবিক’

দেশের ৯টি স্থলবন্দরের সাথে কানেকটিং সড়কগুলোর উন্নয়ন প্রকল্পেই ১৫৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা সম্মানী হিসেবে ব্যয় হবে ৫৩ জন পরামর্শকের পেছনে। প্রতি পরামর্শক পাবেন তিন কোটি টাকার বেশি। তাদের কাজ হলো এক হাজার ৪১০ কিলোমিটার সড়কের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ও ডিটেইল্ড ডিজাইন প্রণয়ন করা। পরিকল্পনা কমিশনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুদ দিয়ে বিদেশ থেকে ঋণ আনা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য। আর এই অর্থের বড় অংশই চলে যাচ্ছে পরামর্শক বা কনসালট্যান্টদের পকেটে। সেটা কারিগরি প্রকল্প হোক বা মূল প্রকল্পই হোক। প্রয়োজনের চেয়েও বেশি পরিমাণে কারিগরি প্রকল্পে পরামর্শক রাখা হয়। এত পরিমাণে পরামর্শক রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, যেখানে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ও ডিজাইন করা হবে, সেখানে এত পরামর্শকের কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না। আর বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা এভাবে খরচ করাটাও অর্থের অপচয়।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ নিয়ে মোট ১৭৬ কোটি ৭৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে দেশের ৯টি স্থলবন্দরের সাথে কানেকটিং সড়কগুলোর উন্নয়ন করা। প্রকল্পের মূল কাজ হলো এক হাজার ৪১০ কিলোমিটার সড়কের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ও ডিটেইল্ড ডিজাইন সম্পন্ন করা। এ কাজের জন্য প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪০ মাস। এখানে বৈদেশিক পরামর্শক হলেন ২০২ জনমাস বা পাঁচজন। স্থানীয় পরামর্শক হলেন ১৮ শ’ জনমাস বা ৪৫ জন। স্বতন্ত্র পরামর্শক হলো ১০০ জনমাস বা তিনজন। এ ছাড়া রয়েছে ২১ জনমাস প্রস্তুতি সাপের্টিং স্টাফ।

ব্যয়ের হিসাব থেকে দেখা যায়, ৫৩ জনের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৯ কোটি ৫৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। গড়ে প্রতি পরামর্শক পাবেন তিন কোটি টাকার বেশি। আর প্রতি মাসে পরামর্শক খাতে ব্যয় হবে তিন কোটি ৮৩ লাখ টাকার বেশি। পরিকল্পনা কমিশন এ কাজের জন্য এত বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয়কে অযৌক্তিক বলছে। পাশাপাশি এত পরিমাণে পরামর্শকের প্রয়োজন আছে কি না?

মহাসড়ক বিভাগের তথ্যানুযায়ী, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফর সাব-রিজিওনাল রোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিট প্রকল্পের আওতায় ২০১৫ সালের জুনে এক হাজার ৭৫২ কিলোমিটার সড়কের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি ও ডিটেইল্ড ডিজাইন করা হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সাথে সম্পর্কিত জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। সেই সমীক্ষায় আওতায় ২৬০ দশমিক ৪০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন কাজ চলছে।

টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফর সাব-রিজিওনাল রোড ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিট-২ প্রকল্পের আওতায় ৫৯০ কিলোমিটার সড়কের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি সম্পন্ন হয়েছে। এখন ডিটেইল্ড ডিজাইন চলতি বছরের ডিসেম্বরে সম্পন্ন হবে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের স্থলবন্দরগুলোর সাথে কানেকটিং সড়কগুলোর উন্নয়নের লক্ষ্যে এই ১৫৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় দর্শনা, ভোমরা, সোনাহাট, হিলি, বিরল, গুবরাকুড়া, বিবিরবাজার, বিলুনিয়া, বাল্লা ও মংলা সমুদ্রবন্দরের সংযোগ সড়ক, পানগাঁও, খানপুর অভ্যন্তরীন কনটেইনার টার্মিনাল, ধীরাশ্রম অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল সড়ক যোগযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র বলছেন, এডিবি প্রস্তাবিত প্রকল্পের কনসেশনাল লোন হিসেবে এক কোটি ৩৬ লাখ ডলার প্রদান করবে। এডিবির সাথে চলতি মাসেই এ ব্যাপারে চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রকল্পের ব্যয়ের মধ্যে প্রকল্প সাহায্য খাতে এডিবির ঋণ হলো ১১২ কোটি ৯৬ রাখ ৬৬ হাজার টাকা এবং বাকিটা বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়ন।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য শামীমা নার্গিস স্বাক্ষরিত কার্যপত্রে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরামর্শকের সংখ্যা, সম্মানী বা ভাতাদি এবং স্থানীয় পরামর্শকদের সংখ্যা আলোচনা করে যৌক্তিকভাবে হ্রাস করতে হবে। জনবলের ব্যাপারে অর্থ বিভাগের কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জনবলের সংখ্যা নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী এ খাতের ব্যয় প্রাক্কলন করতে হবে। বৈদেশিক প্রশিক্ষণের ব্যয় দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে এক কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।

ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইনান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরির মতে, এ ধরনের উদ্যোগ ভালো। অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করবে। উন্নয়নের সুফল সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে। বন্দর এলাকাগুলোর সাথে রাজধানীর একটা সংযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রকল্পে এত বেশি পরিমাণে পরামর্শকের কোনো প্রয়োজন আছে কি? এটি অস্বাভাবিক বলে আমার কাছে মনে হয়। কাজটি হলো যেসব রাস্তা আছে তা উন্নত করা। সমীক্ষা তো আগেই করা আছে। সেখানে এত বেশি পরামর্শকের কেন প্রয়োজন; যাদের জন্য ১৬০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। এটি অবশ্যই অর্থের অপচয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top