যে কারণে নুরুকে মেনে নিলেন শোভন

যেকোনো মূল্যে শিক্ষাঙ্গন শান্ত রাখতে চায় সরকার। ক্যাম্পাসের কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাতে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক সরকারের শীর্ষ কর্তারা। সে জন্য ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে ওঠা পরিবেশ তড়িঘড়ি করে সামাল দেয়া হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ভূমিকা রেখেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সূত্রগুলো জানায়, ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিলমারাসহ নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি সরকারবিরোধীরা। আর শিগগিরই বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ্যও তাদের নেই বলে মনে করা হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সব ধরনের শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে অনেকটাই নির্ভার অবস্থায় রয়েছে সরকার। তবে সামাজিক নানা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেকোনো মুহূর্তে নতুন করে নির্দলীয় কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে সরকারে। ঠিক এমন মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) নির্বাচন নিয়েও খানিকটা শঙ্কায় ছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো আন্দোলন শুরু হলে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা ছিল তাদের। জাতীয় নির্বাচনের মতো ডাকসু নির্বাচনেও আগের রাতে সিলমারাসহ নানা অনিয়মকে কেন্দ্র করে সে রকম একটি পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছিল ক্যাম্পাস। তবে শেষ মুহূর্তে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের হস্তক্ষেপে ভিপি পদে ছাড় দেয়ায় তা আর বেশিদূর এগোয়নি।

এর আগে শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে সাধারণ ছাত্রদের সাথে হল প্রভোস্ট ও মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের ছেলের দুর্ব্যবহারে আন্দোলন শুরু হলে সাথে সাথেই পদত্যাগ করেন প্রভোস্ট। ক্যাম্পাস শান্ত রাখার কৌশল হিসেবে তাকে পদত্যাগের পরামর্শ দেয় কর্তৃপক্ষ।
ডাকসু নির্বাচনের নিরপেক্ষ পরিবেশ নিয়ে শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিল সরকারবিরোধী এবং স্বতন্ত্র সব প্রার্থী। এমন অভিযোগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই সোমবার ভোটগ্রহণ শুরু হলে আগের রাতে সিলমারা ব্যালট পেপারের বক্স উদ্ধার, ভিপি প্রার্থীর ওপর হামলাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে ভোট বর্জন করে ছাত্রলীগ ছাড়া সবাই। শুধু তাই নয়, ভোট বর্জন করে অবস্থান, বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের ডাক দেয় সব সংগঠন। একে একে বিভিন্ন হল থেকে ফলাফল আসতে থাকলে সেই বিক্ষোভ আরো বাড়তে থাকে। ঢাকসুর সব ক’টি পদে ছাত্রলীগ এগিয়ে আছে এমন খবর ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। আবার মাঝে মধ্যে খবর আসে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থীরাও বিভিন্ন পদে এগিয়ে আছে। কিন্তু প্রশাসন সেই ফল পাল্টে ছাত্রলীগকে বিজয়ী ঘোষণার চেষ্টা করছে। এতে আরো ফুঁসে ওঠে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মধ্যরাত পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়ে তারা বিক্ষোভ করতে থাকেন।

এমন প্রেক্ষাপটে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগকে দেখভালের দায়িত্ব পাওয়া আওয়ামী লীগ নেতারা ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী একটি জায়গায় দফায় দফায় বৈঠক করেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে বারবার যোগাযোগ করে আপডেট নেন তারা। অন্য পদগুলোতে ছাত্রলীগ অনেক এগিয়ে থাকলেও ভিপি পদে কখনো ছাত্রলীগের শোভন আবার কখনো নুরু এগিয়ে আছে বলে খবর আসে। ভিপি পদটি ছাত্রলীগ পেলে ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি কি হতে পারে আর ছেড়ে দিলে কি হতে পারে তা নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ চলে আওয়ামী লীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে। পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অবহিত করা হয়। এরই মধ্যে কখনো ছাত্রলীগের শোভনকে ভিপি আবার কখনো নুরুকে ভিপি ঘোষণা দেয়া হচ্ছে এমন খবর পুরো ক্যাম্পাসে ছড়ায়। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মী ও সমর্থকরা তাদের অভিনন্দন জানিয়ে স্ট্যাটাসও দেন। তবে শেষ মুহূর্তে সম্ভাব্য আন্দোলনের আশঙ্কায় ভিপি পদটি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই নুরুকে ভিপি হিসেবে ঘোষণা করে ফলাফল দেয়া হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন খানিকটা প্রশমিত হয়। গতকাল মঙ্গলবার ধর্মঘটের ডাক দেয়া হলেও তা প্রত্যাহার করে নেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

এ দিকে নুরুকে ভিপি ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে খানিকটা ছেদ পড়লেও ছাত্রলীগ নতুন করে ভিসি০বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। তারা ভিসিকে কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে শোভনকে ভিপি ঘোষণার দাবি জানায়। নবনির্বাচিত ভিপি গতকাল ক্যাম্পাসে গেলে তার ওপর দ্বিতীয় দফায় হামলাও চালায় ছাত্রলীগ। তবে ছাত্রলীগের এ আন্দোলনেও পানি ঢেলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ফলাফল মেনে নিয়ে আন্দোলন থেকে সরে এসে যেকোনো মূল্যে ক্যাম্পাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কঠোর নির্দেশনা দেন ছাত্রলীগকে। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশের পরই পরাজিত ভিপি প্রার্থী শোভন তার প্রতিদ্বন্দ্বী নুরুকে মেনে নিয়ে কোলাকুলি করেন। তাকে সব ধরনের সহযোগিতারও আশ্বাস দেন ছাত্রলীগ নেতারা। এর মাধ্যমে ক্যাম্পাস আপাতত শান্ত অবস্থায় ফিরে আসে।

ছাত্রলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুইজন আওয়ামী লীগ নেতা এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘এ মুহূর্তে সরকার ক্যাম্পাস পরিস্থিতি শান্ত রাখতে চায়। কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে যাতে ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল হয়ে না উঠে সে ব্যাপারে সদা সতর্ক সরকার। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্পর্শকাতর জায়গা। সেখানে কোনো আন্দোলন দানা বাঁধলে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এর আগে কোটাবিরোধী আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে সরকারকে বেগ পেতে হয়েছে। সে জন্য আমাদের ভিপিপ্রার্থী হেরে গেলেও সরকার ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top