ভারতে লোকসভা নির্বাচন শুরু হচ্ছে ১১ এপ্রিল থেকে। এত বড় একটি দেশ, তারপরও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সাধ্য নেই কারোই, সে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন। সে দেশের নির্বাচন কমিশনও কিন্তু হঠাৎ করেই এ অবস্থানে আসেনি। সংস্থাটির শক্তিশালী অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান টি এন শেষনের।
শুরুটা যেভাবে
১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাস। দিল্লিতে সেদিন ভীষণ ঠান্ডা। রাত প্রায় একটার সময়ে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী সুব্রামনিয়াম স্বামীর সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়িটা দিল্লির পান্ডারা রোডের একটা সরকারি বাড়ির গাড়িবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ওই বাড়িতে তখন থাকতেন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য টি এন শেষন।
হন্তদন্ত হয়ে শেষনের বাড়িতে ঢুকলেন মন্ত্রী। সুব্রমনিয়াম স্বামী যখন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, সেই সময়ে সেখানে ছাত্র ছিলেন শেষন, যদিও শিক্ষকের বয়স ছাত্রের থেকে কিছুটা ছোটই ছিল। তবে মাঝে মাঝেই দক্ষিণ ভারতীয় খাবার খেতে শিক্ষক হাজির হতেন ছাত্রের ফ্ল্যাটে।
সেই রাতে কিন্তু মন্ত্রী সুব্রামনিয়াম স্বামী অত রাতে টি এন শেষনের সরকারি আবাসে খেতে যান নি। প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের দূত হয়ে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন তিনি। সাবেক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে রাজি আছেন আপনি? এ কথায় খুব একটা উৎসাহ দেখান নি শেষন। কারণ আগের দিন আরেক শীর্ষ আমলা বিনোদ পান্ডেও তার কাছে এই একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
শেষন বলেছিলেন, বিনোদ, আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওই নির্বাচন কমিশনে কে যাবে! কিন্তু সুব্রামনিয়াম স্বামী ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। দুঘণ্টা ধরে তিনি শেষনকে বোঝাতে লাগলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদটা নেয়ার জন্য। শেষমেশ শেষন জানান, কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে বিষয়টি জানাবেন তিনি।
টি এন শেষনের জীবনী ‘শেষন- অ্যান ইন্টিমেট স্টোরি’-র লেখক সিনিয়ার সাংবাদিক কে গোবিন্দন কুট্টি বলছেন, স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পরে সে সময়েই রাজীব গান্ধিকে ফোন করেন শেষন। তখনই একবার দেখা করতে চান তিনি।
প্রথমে তো পাঁচ মিনিট সময় চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা খুব দ্রুতই পেরিয়ে গেল। চকোলেট দুজনেরই খুব পছন্দের জিনিস ছিল। চকোলেট খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনার পরে রাজীব গান্ধি শেষনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ গ্রহণের জন্য সম্মতি দিতে বলেন । শেষন রাজীব গান্ধির এই সিদ্ধান্তে খুব একটা খুশি হন নি।
দরজার দিকে অতিথিকে এগিয়ে দিতে গিয়ে রাজীব গান্ধি বলেছিলেন, দাড়িওয়ালা কিছুদিন পরে সেই দিনটাকে দোষ দেবে, যেদিন তিনি আপনাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দাড়িওয়ালা বলতে গান্ধি সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরকে বুঝিয়েছিলেন।
রাজীব গান্ধি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই তার সঙ্গে টি এন শেষনের সুসম্পর্ক ছিল। বন ও পরিবেশ দপ্তরের সচিব হিসাবে শেষনের কাজে খুশি হয়ে গান্ধি তাকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব দেন। তখন থেকেই দুজনের ঘনিষ্ঠতা।
দেব-দেবীর ছবি বের করে দিয়েছিলেন দপ্তর থেকে
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার প্রস্তাবে সায় দেয়ার পরে তিনি যখন নির্বাচন কমিশনের কাজে যোগ দিলেন, তখন সেখানে তার পূর্বসূরি পেরি শাস্ত্রীর রাখা অনেকগুলো দেব-দেবীর ছবি ছিল। শেষন কাজে যোগ দিয়ে প্রথম দিনই সেই সব ছবি, মূর্তি – সব সরিয়ে ফেলার আদেশ দেন। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই ধার্মিক ছিলেন। কাজে যোগ দেয়ার কিছুদিন পর থেকেই কাজের ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রমাণ পাওয়া শুরু হয়।
পরিবর্তনের শুরু
একটা সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন যে কতটা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারত, তার একটা আন্দাজ দিতে পারি। আমারই এক পূর্বসূরি ৩০ টাকা অনুমোদনের জন্য সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। একটা বই কেনার জন্য ওই টাকার প্রয়োজন ছিল। সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনকে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা একটি প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হত।
তিনি বলেছিলেন, আমার মনে আছে, যখন ক্যাবিনেট সচিব ছিল, সেই সময়ে একবার প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে বলেছিলেন যে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দিন যে কোনো কোন দিন নির্বাচন করাতে চায় সরকার। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, এটা আমরা বলতে পারি না। নির্বাচন কমিশনকে শুধুমাত্র এটুকুই আমরা বলতে পারি যে সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত, ওই সাক্ষাতকারেই জানিয়েছিলেন তিনি।
একটা সময় ছিল, যখন আইন মন্ত্রীদের ঘরের বাইরে অপেক্ষা করতে হত নির্বাচন কমিশনারদের, যে কখন ভেতর থেকে ডাক আসবে। আমি ঠিক করেছিলাম,আমি নিজে কখনো মন্ত্রীর দপ্তরে যাব না। আমাদের দপ্তরে আগে চিঠি আসত নির্বাচন কমিশন, ভারত সরকার – এই ভাবে। টি এন শেষন বলেছিলেন, আমি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি ভারত সরকারের অংশ নই।
রাজীব গান্ধি নিহত হওয়ার পরেই সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই তিনি লোকসভা নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
শীর্ষ আমলাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁর আমলে
১৯৯২ সালের গোঁড়ার দিক থেকেই ভুল করলেই সরকারি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু করেন তিনি। এদের মধ্যে যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবরা ছিলেন, তেমনই ছিলেন নানা রাজ্যের প্রধান সচিবরাও। একবার নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের যুগ্ম সচিব কে ধর্মরাজনকে ত্রিপুরা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি আগরতলা না গিয়ে দপ্তরের অন্য কোনো কাজে থাইল্যান্ড চলে গিয়েছিলেন।
শেষন দ্রুত আদেশ জারি করেন, মি ধর্মরাজনদের মতো অফিসারদের বোধহয় ভুল ধারণা রয়েছে যে নির্বাচন কমিশনের দেয়া দায়িত্বটা একটা বোঝা। পালন করলেও হয়, না করলেও হয়। তিনি যদি মনে করে থাকেন ভোটের কাজের থেকে বিদেশে যাওয়া বেশি জরুরী, এই ভুল ধারণাটা ভেঙে দেয়ার দরকার আছে।”
এর জন্য ধর্মরাজনকে কড়া শাস্তি দেয়াটাই উচিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই রাস্তায় না হেঁটে তার চাকরিজীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ নথি – কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্টে এই গুরুতর বিষয়টির উল্লেখ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন, এক আদেশে তার ব্যাপারে এটাই লিখেছিলেন শেষন।
ভারতে কনফিডেন্সিয়াল রিপোর্ট একজন সরকারি চাকরিজীবীর কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথি, যা দিয়ে তাদের পদোন্নতি নির্ভর করে।
একের পর এক নির্বাচন স্থগিত করে দিতেন তিনি
শেষনের একের পর এক নির্দেশের ফলে রাজনৈতিক মহলে শোরগোল পড়ে যায়। ১৯৯৩ সালের ২রা অগাস্ট টি এন শেষন একটা ১৭ পাতার নির্দেশ জারি করেন। তাতে লেখা হয়, যতদিন না নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সরকার পুরোপুরি স্বাধীনতা দিচ্ছে, ততদিন দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।
তিনি বলেন, ভারত সরকারের নিজেই এমন কিছু প্রথা সৃষ্টি করেছে, যার ফলে নির্বাচন কমিশন তার নিজের সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে অসমর্থ হচ্ছে। তাই নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কমিশনের অধীনে যত নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই সব ভোট প্রক্রিয়া বন্ধ থাকবে পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত। এই নির্দেশের যে প্রবল বিরোধিতা হবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার একটি আসনের নির্বাচন হতে দেন নি শেষন। যার ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীর সময়কাল শেষ হয়ে গিয়েছিল আর তাকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী জ্যোতি বসু এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে টি এন শেষনকে তিনি ‘পাগলা কুকুর’ বলে ফেলেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বলেছিলেন, ‘আমরা এতদিন কারখানায় লক আউট জানতাম। শেষনের আমলে তো গণতন্ত্রই লক আউট হয়ে গেল।
কার সঙ্গে লড়াই করেননি শেষন?
টি এন শেষন প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে যতদিন কাজ করেছেন, সেই সময়ে এমন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না বোধহয়, যার সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে নি! রাজনৈতিক দলগুলো বা সংবাদমাধ্যম তার নাম দিয়েছিল ‘টাইট নাট শেষন’ – তিনি সবাইকে ‘টাইট’ দিতেন বলে।
এই তালিকায় প্রধানমন্ত্রী নরসিনহা রাও যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল গুলশের আহমেদ বা বিহারের প্রধানমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব। শেষনই প্রথমবার বিহারে চার দফায় নির্বাচন করার কথা ঘোষণা করেন। আর প্রতিটা দফার তারিখ বদলাতে থাকেন।
এম এস গিল, যিনি পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, শেষনের সব থেকে বড় অবদান এটাই যে তিনি নির্বাচন কমিশনকে একটি পর্যায় নিয়ে এসেছিলেন। তার আগে কেউ তো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নামই জানত না। আর প্রত্যেকেই নির্বাচন কমিশনকে হেলাফেলা করে চলতো।
বলা হয়ে থাকে, টি এন শেষনই ভারতের নির্বাচন কমিশনকে তার সংবিধান স্বীকৃত স্থানে বসিয়ে গেছেন। এখন যে ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তা শেষনের আমল থেকেই শুরু হয়। একদিকে ভোটের প্রতিটা বিষয়ের ওপরে নজরদারী চলতে থাকে, আর ব্যবস্থা হয় শাস্তিরও।
১১ ডিসেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। তবে তিনি যে ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, সেই ট্র্যাডিশনই এখনও চলছে।