বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা ও কিছু কথা

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এবং ৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে তাদের সম্মানজনকভাবে পুনর্বাসন করা সম্ভব ছিল না বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন সরকারি চাকরিতে পদের সংখ্যা বর্তমানের ২০ শতাংশও ছিল না বিধায়, যোগ্যতা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সব মুক্তিযোদ্ধাই যাতে সরকারি চাকরি করতে পারে, তজ্জন্য তাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স অমুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে পাঁচ বছর বেশি করে ৩০ বছর নির্ধারণ করেছিলেন, বর্তমানে যা ৩২ বছর। এই কোটা সংরক্ষণে সবাই খুশিই হয়েছিলেন। গত ৪৭ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে এবং এখন এগিয়ে যাচ্ছে তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। এ দিকে, মৃত্যুজনিত কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমছে এবং এর বিপরীতে, জনসংখ্যা আড়াই গুণ বেড়ে ১৭ কোটিতে পৌঁছেছে।

কোটি মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের অদম্য বাসনা ছিল। সবার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ সম্ভব না হলেও প্রত্যেকে যে যার অবস্থানে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাদ্য ও অর্থ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করায় তারা একেকজন সহযোদ্ধায় পরিণত হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা যৌক্তিক ছিল বিধায় এতে কারো দ্বিমত ছিল না। তবে সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার বয়স যখন ৩২ বছর পেরিয়ে যায়, তখনই এই কোটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে অনেকে মনে করেন। যখন এই কোটা বংশানুক্রমে করা হলো তখন সমস্যা সৃষ্টি হলো। শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং যে মুক্তিযোদ্ধা অনিবার্য কারণে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুবিধা নিতে পারেননি, তাদের সন্তান পর্যন্ত কোটা থাকতে পারে। ঢালাওভাবে সবার সন্তানদের ৩০ শতাংশ কোটা দেয়ার কারণে অনেক পিতা সন্তানের জন্য নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে কিংবা পুত্র বা পৌত্র বাবাকে বা দাদাকে মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নামা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বেমানান।

ধরুন, একই ইউনিয়নে ৪ জন সহপাঠী মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের স্থানীয় ক্যাম্পে যোগ দিয়ে অস্ত্রসমর্পণ পর্যন্ত তাদের সাথে থাকার সুবাদে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জোগাড় করে নিয়েছিলেন। বাকি তিনজন স্বাধীনতার পূর্বাপর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেও মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট না থাকার কারণে সরকারি চাকরির সুযোগ বঞ্চিত হয়েছিলেন। তেমনি তাদের সন্তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভালো ফলাফল করে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও কোটার কারণে মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যান। কোটা সুবিধায় মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারী সেই সহপাঠী নিজেও যেমন সরকারি চাকরি পেয়েছিলেন, তেমনি তার দুই পুত্রও ক্যাডারে চাকরি পেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে গ্রামে রাজাকারদের গোলাগুলির সময় দৌড়ে পালাতে গিয়ে দশম শ্রেণীর এক ছাত্রের হাতে গুলি লেগেছিল।

তিনি স্বাধীনতার পর ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে সার্টিফিকেট জোগাড় করতে পেরেছিলেন। সেই সুবাদে সরকারি ব্যাংকে চাকরি পেয়ে কয়েকবার পদোন্নতি পেয়েছিলেন। বর্তমানে অবসরে গিয়ে মাসে ৩০ হাজার টাকা পেনশন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতাও পাচ্ছেন। তার পুত্র মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পেয়েছেন। অথচ তা গ্রামে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের বংশানুক্রমে কোটার সুযোগ জনগণের বিরাট অংশের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, ১৯৭৩ সালে গ্রামে স্বাস্থ্য বিভাগ ও কৃষি বিভাগের সরকারি কর্মী, প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি হাইস্কুল ও কলেজে শিক্ষক-কর্মচারীদের বিধিবদ্ধ রেশনিং সুবিধার আওতায় নেয়া হলে তাদের পরিবারের সদস্যরা সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মাথাপিছু ২ কেজি করে চাল-গম সরকারি ভর্তুকি মূল্যে (বাজারদরের অর্ধেকেরও কম) পেতেন।

পক্ষান্তরে, সাধারণ দুস্থ জনগণের একটা অংশ মাসে একবার মাত্র মাথাপিছু ২ কেজি খাদ্যশস্য ভর্তুকি মূল্য পেত। গ্রামের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এবং কলেজ শিক্ষকদের অধিকাংশ ছিলেন মোটামুটি সচ্ছল ঘরের সন্তান। তাই তারা যখন প্রতি সপ্তাহে রেশনের চাল ও গম উঠিয়ে সাইকেলে করে ফিরতেন বা অনেকে বাজারদরে এগুলো বিক্রয় করে দিতেন, তখন অনেকেই ওই সুবিধাপ্রাপ্ত লোকদের ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আপনারা হচ্ছেন সরকারের পোষ্য পুত্র।’ তাই বিশেষ সুযোগ লাভ করেছেন। তেমনি, বর্তমানে বৈষম্যমূলক পদক্ষেপে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানির কারণ সৃষ্টি হয়েছে।

শহীদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এত দিনে পেরিয়ে গেছে। তাদের নাবালক সন্তান ও স্ত্রী থাকলে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিতে পারে, যতদিন পর্যন্ত তারা সাবালক হয় অথবা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী জীবিত থাকেন। মৃত্যুবরণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্ত্রী বা স্বামীর সরকারি চাকরির বিদ্যমান পেনশন সুবিধা চালু করা হোক। সরকারি কর্মচারী পেনশন নিজে বা তার অবর্তমানে স্ত্রী আজীবন ভোগ করতে পারেন এবং নাবালক সন্তানেরা সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তা ভোগ করতে পারেন। তেমনি ব্যবস্থা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চালু করা হোক।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top