পটকা মাছ খেলে মৃত্যু ঝুঁকি আছে : বিএফআরআই মহাপরিচালক

পটকা মাছ খেয়ে চলতি সপ্তাহে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় একজন অন্তঃসত্ত্বা মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এরআগে পটকা মাছ খেয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এক পরিবারের দুই জন মারা গেছেন।

২০১৫ সালে সিলেটের জৈন্তাপুরেও পটকা মাছ খেয়ে মারা গেছেন পাঁচজন। কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনাতেও পটকা খেয়ে মৃত্যুর খবর শোনা গেছে। প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন এলাকায় পটকা মাছ খেয়ে ৫/৭ জন মারা যাবার খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেছেন, এসব মৃত্যুর পেছনে মূলত; ভোক্তার অজ্ঞতা ও অসাবধানতা দায়ী। ইতোপুর্বে এ নিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এরপরও প্রায়শই এমন খবর গণমাধ্যমে আসছে। পটকার মধ্যে কোনটি বিষাক্ত এবং কোনটি বিষাক্ত নয় এবং কোনটি কোন সময়ে বিষাক্ত এ ধরণের সঠিক তথ্য নেই। স্থানভেদে বিষাক্ততার তারতম্য কতটুকু তাও জানা নেই। তাই মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এড়াতে পটকা খাওয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম বলে মনে করেন তিনি।

পটকা মাছ বাংলাদেশের নদীতে সচরাচর পাওয়া যায়। এর সামুদ্রিক জ্ঞাতির নাম বেলুন মাছ। এর দেহ প্রায় গোলাকার, মাথা চওড়া, দেহখÐও চওড়া তবে লেজের ঠিক পূর্বে হঠাৎ সরু হয়ে গেছে। উপরিতল থেকে সামান্য নিচে মুখ, উভয় মাড়ীতে দু’টি ছেদন দন্ত রয়েছে। পটকা মাছ ইংরেজিতে বেøা বা বেলুন মাছ হিসেবে পরিচিত। স্থানীয়ভাবে পটকা বা টেপা মাছ নামে সমধিক পরিাচত। দেখতে গোবেচারা টাইপের হলেও মাছটি অত্যন্ত বিষাক্ত। বাংলাদেশে পটকা মাছের ১৩টি প্রজাতি আছে। যাদের দু’টি মিঠা পানিতে এবং বাকীগুলো সমুদ্রে লোনাপানিতে বাস করে। স্বাদুপানির পটকা আকারে লোনাপানির পটকার চেয়ে অনেক ছোট। পটকা মাছের বিষ টেট্রোডোটক্সিন (টিটিএক্স) একটি শক্তিশালী বিষাক্ত পদার্থ যা মানুষের উত্তেজক (এক্সাইট্যাবল) সেল মেমব্রেনের সোডিয়াম চ্যানেল বন্ধ করে দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু ঘটাতে সক্ষম।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, পটকা মাছ (সামুদ্রিক) জাপানে একটি দামি, সুস্বাদু ও অভিজাত শ্রেণীর মাছ হিসেবে পরিচিত। পটকা মাছ জাপানিদের ঐতিহ্যের অংশ। কোনো কোনো জাপানি পটকা মাছকে কাজের উদ্যম সৃষ্টির প্রতীক হিসেবে মনে করেন। জাপানিরা বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে পটকার কোন প্রজাতি কোন এলাকায় কোন সময় বিষাক্ত তা ইতোমধ্যে জেনে গেছে। তারা মূলত; চাষের পটকা খায়। হোটেল রেস্তোরায় পটকার মেনু তৈরির জন্য রয়েছে লাইসেন্সধারী বিশেষ শ্যাফ। তবুও পটকা মাছ খেয়ে জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, চীন ও মেক্সিকোতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে যদিও সে সংখ্যা এখন একেবারেই হাতেগুণা।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পটকা মাছের বিষাক্ততা নিয়ে প্রায় দু’দশক আগে প্রাথমিক কিছু গবেষণা করা হয়। গবেষণায়, দেশের স্বাদুপানিতে দুই প্রজাতির পটকা (Tetrodon cutcutia এবং Chelenodon patoca) পাওয়া গেছে। উভয় প্রজাতির পটকাই কম-বেশি বিষাক্ত। কিন্তু দেশের সামুদ্রিক পটকার বিষাক্ততার মাত্রা সম্পর্কে গবেষকদের ধারণা এখনো সীমিত। গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে ইনস্টিটিউট হতে পরবর্তীতে এ বিষয়ে একটি লিফলেটও প্রকাশ করা হয়।

গবেষনায় দেখা গেছে, সাধারণত প্রজনন মৌসুমে (মে-জুলাই) পটকা মাছ অধিক বিষ বহন করে থাকে। পটকা মাছ সাধারণত টেট্রোডোটক্সিন (টিটিএক্স) নামক বিষ বহন করে। তবে এলাকাভেদে কোনো কোনো সময় পটকা মাছকে Saxitoxin (STX) নামক বিষ বহন করারও নজির আছে। পটকার চামড়া, যকৃত ও গোনাডে সাধারণত অধিক বিষ থাকে। পটকা মাছের বিষাক্ততা অঙ্গ, প্রজাতি, স্থান ও ঋতুভেদে ভিন্নতর হয়। অর্থাৎ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশে পটকা মাছের যে প্রজাতিটি মারাত্মক বিষাক্ত, জাপানে সেটা ততটা বিষাক্ত নাও হতে পারে। অনুরূপভাবে, বৈশাখ মাসে যে পটকা মাছটি বিষাক্ত, কার্তিক মাসে সেটাতে ততটা বিষ নাও থাকতে পারে। তাই অপেক্ষাকৃত কম বিষ ধারণকৃত সময়ে পটকা মাছ খেয়ে ভোক্তার হয়তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে নাই, কিন্তু অজ্ঞতাবশত: অধিক বিষ বহনকালে একই পটকা খেয়ে তার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এলাকাভেদে বিষাক্ততার তারতম্যের জন্যেও একইরূপ দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থাকে।

সামুদ্রিক পটকার ক্ষেত্রে (টেট্রোডোটক্সিন-টিটিএক্স বহনকারী) মানুষের জন্য বিষাক্ততার মাত্রা হচ্ছে প্রতি গ্রামে ১০ মাউস ইউনিট (এমইউ-বিষাক্ততার একক) অর্থাৎ, পটকার প্রতি ১ গ্রাম অংশে যদি ১০ এমইউ বিষ থাকে তবে তা মানুষের জন্য বিষাক্ত। এ পরিমাণ বিষ খেলে তার মধ্যে বিষক্রিয়া শুরু হবে এবং এভাবে যদি এক সাথে ১০ হাজার এমইউ বিষ একজন সুস্থ-সবল মানুষ খেয়ে ফেলে তবে তার নির্ঘাত মৃত্যু। একইভাবে স্বাদুপানির পটকার ক্ষেত্রে প্রতি গ্রামে ৩ এমইউ বিষ ((Saxitoxin, STX)) থাকলে তা বিষাক্ত এবং ৩ হাজার এমইউ বিষ একসাথে খেলে মৃত্যু অবধারিত। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, সামুদ্রিক পটকার চেয়ে স্বাদুপানির পটকা অধিকতর বিষাক্ত।

বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, কোনো কোনো সামুদ্রিক পটকা প্রতি গ্রামে ৪০০০ এমইউ পর্যন্ত বিষ (টিটিএক্স) বহন করে থাকে অর্থাৎ একজন সুস্থ-সবল ব্যক্তি এরূপ বিষাক্ত পটকার ৩ গ্রাম খেলেই বিষাক্রান্ত হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবে। অনেকের ধারণা, পটকা মাছ রান্না করলে এর বিষাক্ততা নষ্ট হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। অত্যধিক তাপে বিষের উপাদান (Chemical Structure) এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তর হতে পারে কিন্তু এতে বিষাক্ততার খুব একটা তারতম্য হয় না। রোগীর দেহে পটকা মাছের বিষক্রিয়ার মাত্রা গৃহীত বিষের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। স্বাদুপানি এবং লোনাপানির পটকার বিষাক্ততার লক্ষণ রোগীর দেহে প্রায় একইরকম। পটকা মাছের বিষকে Neurotoxin কিংবা Sodium channel blocker বলা হয়। পটকা মাছের বিষ (টিটিএক্স এমডবিøউ ৩১৯) মানবদেহের নার্ভ সেলের Voltage-gated sodium ion channel এর সাথে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে। ফলে হার্টে সোডিয়াম প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এতে মানবদেহে ইলেকট্রোলইটিক্যাল ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়। বিষাক্ততায় এক ঘণ্টার মধ্যে পর্যায়ক্রমে রোগীর ঠোঁট ও জিহবায় জড়তা, মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, মুখে শুষ্কতা, মাংসপেশীতে ব্যাথা ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে রোগী পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে থাকে। পরিণামে চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে শ্বাসকষ্টে মৃত্যুও হতে পারে। তাই রোগীর প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে রোগীকে স্থানীয় হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে এবং পাকস্থলী পরিস্কারসহ অন্যান্য Szmptomatic চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। পটকা মাছ খুব একটা সাঁতার কাটতে পারে না। পানিতে এরা অলস ভঙ্গিতে চলাফেরা করে। একটা মাঝারি আকারের জাপানি পটকায় যে টেট্রোডোটক্সিন থাকে, তা ৩০ জনেরও বেশি লোকের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এরা সাধারণত শামুক, ঝিনুক, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি খেয়ে থাকে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, আমাদের দেশের মানুষ জানেই না, পটকা মাছের শরীর আস্ত এটা বিষের থলি। টেট্রোডোটক্সিন নামক বিষ আছে পটকায়। এই বিষ কারও শরীরে ঢুকলে মৃত্যু অবধারিত। পটকার মধ্যে কোনটি বিষাক্ত এবং কোনটি বিষাক্ত নয় এবং কোনটি কোন সময়ে বিষাক্ত এ ধরণের যথেষ্ঠ তথ্য নেই। স্থানভেদে বিষাক্ততার তারতম্য কতটুকু তাও জানা নেই। তাই মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা এড়াতে পটকা খাওয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম। তিনি আরো জানান, পটকা মাছের বিষাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় অদ্যাবধি কোনো ভেকসিন আবিস্কৃত হয় নাই। তাই মৃত্যুর ঝুঁকি এড়াতে পটকা মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বরং এর বিষ আইসোলেট করে তা বৈধভাবে বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। ওষুধ শিল্পে এর বিষ খুবই মূল্যবান সম্পদ হিসেবে ব্যবহারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। ##

Share this post

scroll to top