দেশের অর্থনীতির কাম্য গতি-প্রকৃতি

নন্দিত অর্থনীতি কী, বৈষম্যহীন অর্থনীতি কাকে বলে? একটি বাক্য দিয়ে তার মর্ম আমরা উপলব্ধি করতে পারব। এই বাণীটি নবীজীর হাদিস। রাসূল সা: কুরআনের বাইরে একটি কাজও করেননি। যেহেতু এটা আল্লাহর বাণী, আর তা হলো ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার মজুরি পরিশোধ করো।’ নবীজীর নবুয়ত পাওয়ার পর ২৩ বছর জীবন ছিল কুরআনের আলোকে গড়া। কুরআন অর্থনীতির যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, রাসূল সা: সেই অর্থনীতি মদিনার শাসনব্যবস্থায় বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। রাসূল সা: বলেছিলেন, গরিব প্রতিবেশীদের সাহায্য করো, সে যে ধর্মেরই মানুষ হোক না কেন। তাকে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে, যদি অর্থ না থাকে তাহলে কর্মের মাধ্যমে বা মৌখিক ভালোবাসা দিয়ে হলেও তাকে সাহায্য করো।

এতিমদের হক আদায় করা ছাড়া ধনীরা অর্থাৎ সম্পদশালীরা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এর অর্থ হলো, ধনীদের অর্থের ওপর গরিবের হক আছে। সুতরাং জাকাত দাও। তাহলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য থাকবে না, নামাজে দাঁড়ালে ধনী-গরিব, এতিম-মিসকিন যেমন এক হয়ে যায়, ঠিক তেমনি তোমরা তোমাদের অর্থব্যবস্থা কায়েম করো, তাহলে পৃথিবীটাই বদলে যাবে- ইতিবাচকভাবে। মানুষ তখন পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কোনো রকম হিংসা-বিদ্বেষ, সন্ত্রাস ফেতনা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা কিছুই থাকবে না। অর্থনীতির দাসত্ব থেকে পৃথিবীর সব মানুষ মুক্তি পাবে। খোলাফায়ে রাশেদিনের ৩০ বছর শাসনামলে নবীজীর চার উত্তরসূরি ওই অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থা অর্ধ পৃথিবীর বেশির ভাগ অংশে কায়েম করেছিলেন বলে অনৈতিক অর্থব্যবস্থা বর্তমানে যেভাবে দাসত্ব, প্রভুত্ব, বৈষম্য সৃষ্টি করেছে- তা তখন ছিল না। থালা-বাসন নিয়ে মসজিদের পাশে রাস্তার ধারে কোনো ভিক্ষুককে তখন দেখা যায়নি। হজরত ওমর রা:-এর আমলে এমনো দেখা গেছে, সরকারি ভাণ্ডার থেকে অর্থ ও খাদ্য দিয়ে সাহায্য দেয়ার মতো আরব ভূখণ্ডে কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে জন্য হজরত ওমর রা: উচ্চকণ্ঠে বলার সাহস পেয়েছিলেন- ফোরাত নদীর পাশে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে থাকে- তাহলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ধরনের অর্থব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও এখন খুঁজে পাওয়া যাবে কি?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বব্যাংক এবং তার সহযোগী আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিদেশী সাহায্যের আবরণে আসত ঔপনিবেশিক পুঁজিই রাষ্ট্রের ভূমিকা এবং পরিকল্পনার ব্যবহারও নির্ধারণ করে। এসব আর্থিক সংস্থা বিদেশী সাহায্যের নামে, মানুষের অর্থ সম্পদ লুণ্ঠন করে তাকে ঋণগ্রস্ত করে গড়ে তোলে। বিদেশী সাহায্যকে একই সাথে রাজনৈতিক আধিপত্যের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা ইত্যাদি কাজগুলো পুঁজিবাদী কেন্দ্র দেশগুলোর জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রত্যক্ষ উপনিবেশের সংখ্যাই ছিল অধিক। এ কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ উপমহাদেশসহ আরো বহু রাষ্ট্র তাদের করতলগত ছিল। সাম্রাজ্য বিস্তার এবং অর্থ লুণ্ঠন ছিল তাদের মূল কাজ। এ জন্য সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো ধর্ম, বর্ণ, ভাষাকে টার্গেট করে মানুষের মধ্যে হানাহানি ও বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থকে সম্প্রসারিত করেছে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান বিকাশ ধারা যা বিশ্বায়ন নামে বহুল পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানের অনুন্নত দেশগুলো ৪০ দশক পর্যন্ত সাধারণভাবে প্রত্যক্ষ উপনিবেশ ছিল।

বর্তমান দেশের পরিস্থিতি এমনই যে, এখন দেশে মালিক বলতে যদি কিছু বোঝায় সেটি হলো এই ‘দাতা’ সংস্থাগুলো। এই ‘দাতা’ সংস্থাগুলোর নেতা বিশ্বব্যাংক। এ ছাড়া আছে আইএমএফসহ যাবতীয় আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এবং আছে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি স্থানীয় ব্যক্তি ও সংস্থাগুলো। (সূত্র : ক্রান্তিকালের বিশ্ব অর্থনীতি ও উন্নয়ন সাম্রাজ্য আনু মুহাম্মদ)।

যে কথাটা প্রথম বলেছিলাম- ইসলাম বিশ্বে দিয়েছে বৈষম্যহীন এক অর্থব্যবস্থা। কাজের বিনিময়ে পাওনা পরিশোধ- তাও সাথে সাথে পাওনা মিটিয়ে দেয়া হতো। জামানত রাখলে বা কোনো কিছুর বিনিময়ে ওয়াদাবদ্ধ হলে- তা খেয়ানত করা হতো না। এমন এক অর্থব্যবস্থা বা জীবনপ্রণালী ইংরেজিতে যাকে বলেPeoples oriented economics, বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় গণমুখী অর্থনীতি। এই অর্থব্যবস্থা ইসলামের সোনালি যুগে অর্ধ পৃথিবীতে কায়েম করা হয়েছিল। শোষণের কোনো প্রক্রিয়া সেই অর্থব্যবস্থায় ছিল না। বুর্জুয়া ও আমলাতান্ত্রিক সৃষ্টির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি সেই অর্থব্যবস্থায়। কেউ থাকবে গাছতলায়, কেউ থাকবে পাঁচতলায় এই শিক্ষা ইসলামিক অর্থনীতিতে ছিল না। ইসলামের অর্থনীতির মূল শিক্ষা ছিল- রাজার আগে প্রজার বাড়ি নির্মিত হতে হবে। রাজা বা শাসক সম্প্রদায় শান-শওকতে থাকবে, বিলাসী জীবন যাপন করবে, আর প্রজা শুধু শোষিত হয়ে কষ্ট পাবে- এ ধরনের অর্থনীতি ইসলামের ৩০ বছরের শাসনামলে দেখা যায়নি।

বিদেশী কোনো মেহমান এলে স্বচোখে দেখতে পেতেন ‘অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা শুয়ে আছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন ক্ষণিকের জন্য খেজুরের পাতায় নির্মিত চাটাইয়ে উন্মুক্ত আকাশের নিচে খোলা ময়দানে। তার কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না- দেহরক্ষী পর্যন্ত তার জন্য বরাদ্দ করা হয়নি। এটাই ছিল খলিফার নির্দেশ। তিনি বলতেন- তার নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর সাহায্যই যথেষ্ট। কারণ হলো- শাসনকর্তা সব মানুষকে একই নিয়মে পর্যবেক্ষণ করতেন। দল-মত, ধর্ম-বর্ণ এসব তখন বিবেচনায় ছিল না। বিবেচনায় ছিল মানুষ। যাকে আমরা এখন বলি সব ক্ষমতার উৎস। বাস্তবে তার প্রমাণ অর্থনীতিতে নেই বললেই চলে। একটি পশুও তখন অভুক্ত থাকতে দেখা যায়নি।

হজরত ওমরের কঠোর বার্তা- ফোরাত নদীর কূলে কোনো কুকুর যদি না খেয়ে থাকে তাহলে আমি ওমরকে রোজ কিয়ামতের দিন জবাবদিহি করতে হবে। ধর্ষণ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, কাকে বলে মানুষ সেই সময় জানত না। এক রূপবতী মহিলা জরুরি প্রয়োজনে গভীর রাতে মরুময় সড়ক দিয়ে পথ চললে কেউ তার শালীনতা বিনষ্ট করার সাহস পেত না। সিস্টেমই বলে দিত- তোমার নজর খারাপ কাজ থেকে অবনমিত করো। অন্যথায় কঠোর শাস্তি। ইসলামী শাশ্বত বাণী যখন অন্তরে প্রবেশ করে, তখন সে আর খারাপ কাজ করতে পারে না। আজ আমাদের হৃদয়ে কতগুলো রোগ বাসা বেঁধেছে। যেমন- লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, প্রতিহিংসা, গিবত, অন্যের ক্ষতির চিন্তা- যার কারণে কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সুপরিকল্পিতভাবে সুসম্পন্ন হচ্ছে না। পুলিশ, মেলিটারি, র‌্যাব, বিজিবি দিয়েও কাজ হচ্ছে না। নৈতিকতার ভিত্তি যদি শক্ত না হয় তাহলে কোনো প্রক্রিয়া দিয়ে অপরাধ দমন করা যাবে না।

সাম্যবাদী রাষ্ট্র এবং তার অর্থনৈতিক কাঠামোগত ব্যবস্থা কেমন ছিল উল্লিখিত স্বল্প আলোচনায় যেকোনো জ্ঞানী মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারবেন। আজকের বিশ্বায়ন পুরো পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারেনি, যেটা মধ্যযুগে ইসলামের ৩০ বছরের শাসনামলে সম্ভব হয়েছিল।

অনেকেই ভেবে থাকেন- ইসলাম পারলৌকিক ধর্ম, ইহলৌকিক ধর্ম নয়। এটা বোঝার ভুুল। ইসলাম বলছে- র’ব্বানা আতিনা ফিদদুনিয়া হাসানাতাও’। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২০১ আয়াতে প্রথমে দুনিয়ার কল্যাণের কথা বলা হয়েছে, আখিরাতের কল্যাণের আগে। ইসলাম এ কথাও জোরালোভাবে বলেছে- তোমরা কাজ করো, আমল করো। কিন্তু তোমরা অলস হয়ে বসে থেকো না। ইসলাম কর্মের ধর্ম। ইসলাম এ কথাও বলেছে- তোমরা ব্যবসা করো হালাল পথে, আর এটাই উত্তম পথ- এসব কুরআনের মূলগত শব্দ। সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা এবং মানুষের অধিকারের কথাও বলেছে। মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করতেও নিষেধ করেছে ইসলাম। ইসলাম ‘হাক্কুল ইবাদ’ বান্দার অধিকার ও কল্যাণের জন্য কাজ করতে বলেছে। সাধারণ মানুষ যাদের ইসলাম সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান নেই- তারা যথানিয়মে ধর্মীয় কাজগুলো করে।

কিন্তু এক শ্রেণীর পণ্ডিত ব্যক্তি বিজ্ঞ আলেমসমাজ জুমার নামাজের আগে বা কোনো ওয়াজ মাহফিলে যেখানে সাধারণ মানুষের সমাগম ঘটে… অথবা দুই ঈদের খুতবায় উপরে বর্ণিত ইসলামের শাশ্বত এই সুন্দর ভেজালমুক্ত অর্থনীতির কথা খুব কমই বলেন। সাধারণ মানুষ যদি জানত ইসলামের অর্থনীতি এত সুন্দর এবং শোষণের কোনো ফাঁকফোকর নেই, তাহলে জনকল্যাণ অনেক এগিয়ে যেত। মানুষের কল্যাণ ঘটলেই উপলব্ধি করা যাবে দেশে অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যখনই দেখা যাবে চলন্ত অর্থনীতিকে বাঁকা পথে- নিজেদের স্বার্থে পরিচালিত করা হচ্ছে, তখনই অর্থনীতি বুর্জুুয়াদের স্বার্থে, আমলা ও পুঁজিপতিদের স্বার্থে কাজ করে। তারা অর্থের পাহাড় গড়ে অথচ গরিব মানুষ জাকাত হিসেবে সেই সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত থাকে।

দারিদ্র্য বিমোচনে এত সুন্দর কৌশল ইসলামে থাকা সত্ত্বেও অর্থব্যবস্থায় তা প্রয়োগ করি না। কুরআনের প্রায় ২০০ আয়াতে মানুষের প্রতি ইনসাফ করার কথা বলা হয়েছে। ‘ইনসাফের মূল অর্থ হলো- মানুষের প্রতি জুলুম থেকে বিরত থাকা এবং মানুষের কল্যাণ কামনা করা। প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায় Need fulfillment or Welfare। পাশ্চাত্যের এবং ইসলামের Welfare Economic Systam-এ অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। সাম্রাজ্যবাদী কল্যাণকর অর্থনীতির বিকাশ সাধনে রাষ্ট্রের ওপর সবকিছুর দায়িত্ব বর্তায়। সুতরাং মানুষের অর্থ বিনিয়োগ করে মানুষের কল্যাণের কথা বলে মানুষের ওপরই জুলুমের মতো ট্যাক্স আরোপ করেন। আবার প্রতি বছর এই ট্যাক্স জ্যামিতিক পদ্ধতিতে বাড়তে থাকে। এই ট্যাক্স প্রতি বছরই সাধারণ মানুষ সরকারকে দিয়ে যাচ্ছে। এর পরও রাষ্ট্রকে অনেক বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ করতে হয়। আর এই ঋণ গ্রহণ করলে পশ্চিমা রাষ্ট্রের আদলে সুদাসলে তা পরিশোধ করতে হয়। এমন একসময় আসে তখন দেখা যায় পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র আর চলতে পারছে না।

কারণ এই সিস্টেমে আমলা ও ধনবান ব্যক্তিরা লাভবান হয়, রাষ্ট্র পিছিয়ে যায়। অর্থকে যদি malpractice (Improper, illegal or negligent professional behaviour) বা ক্ষতিকর উপায়ে পরিচালিত করা হয়- তখন অর্থ অনর্থের মূল হিসেবে কাজ করে। লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রের দায়দেনা বেড়ে যায়। ঘুষ, দুর্নীতি-প্রজেক্ট বাস্তবায়নে ব্যয় হয়- যা খাল কেটে কুমির ডেকে আনার মতো অবস্থায় রাষ্ট্র পতিত হয়। দীর্ঘমেয়াদে দেখা যাবে ঋণের অর্থ রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ বোঝায় পরিণত হয়। ফলে একসময় দেখা যায়- খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির কারণে। মুদ্রার মূল্য অস্বাভাবিকহারে কমছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য একটা খারাপ দৃষ্টান্ত।
লেখক : গ্রন্থকার

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top