দুই সন্তান হত্যাকারী মহিলার জামিনের জিম্মাদার স্বামি

দুই সন্তানকে ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যাকারী মহিলা মাহফুজা মালেক জেসমিন জামিন পেয়েছেন। রাজধানীর বনশ্রীর এই ঘটনায় আসামিকে এখন মানসিক রোগী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই গ্রেফতারের প্রায় তিন বছরের মাথায় মামলার বাদী ও তার স্বামীর জিম্মায় জেসমিনকে জামিন দিয়েছেন আদালত। চিকিৎসা করে জেসমিনকে সুস্থ করে তুলবেন এমনটাই আদালতে বলেছেন জেসমিনের স্বামী নিহত অরণী ও আলভীর বাবা আমান উল্লাহ।

চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি শুনানি শেষে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মাকসুদা পারভীন এক লাখ টাকা মুচলেকায় তার জামিন মঞ্জুর করেন। মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ১৯ মার্চ দিন ধার্য আছে। মামলায় ৩৬ সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৯ জন।

এ মামলায় আসামিপক্ষে জামিন শুনানি করেন কাজী নজিবুল্লাহ হিরু।

জামিন আবেদনে উল্লেখ করা হয় আসামি মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত নারী। এছাড়াও মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড আসামি ‘সিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসোডা’ নামক মানসিক রোগে ভুগছেন বলে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে।

জামিন আবেদনে যা উল্লেখ করেন আইনজীবী

২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি জেসমিনের জামিনের আবেদন করেন তার আইনজীবী মাজহারুল ইসলাম হারুন। জামিন আবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসামি জেসমিন একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত নারী। তিনি ২০১৬ সালের ৩ মার্চ হতে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ২ বছর ১০ মাসের বেশি সময় জেল-হাজতে আছেন। আসামি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় বর্ণিত ঘটনার শিকার এবং কথিত ঘটনাটি তার স্বজ্ঞানে ও সুস্থ মস্তিষ্কে সংঘঠিত হয়নি।

সাক্ষীরা আদালতে তাদের জেরায় এসব কথা স্বীকার করেছেন। আসামি একজন মানসিক রোগী (পাগল/উন্মাদ) তা আদালত কর্তৃক কারা কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠানো আদেশ অনুযায়ী প্রাপ্ত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সিটিউট ও হাসপাতাল এর প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে, তিনি একজন ‘সিজোঅ্যাফেক্টিভ ডিসোডা’ নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং তার নিয়মিত চিকিৎসা ও ফলোআপ প্রয়োজন।

এমতাবস্থায় আসামি গুরুতর অসুস্থ এবং জেল-হাজতে আটক থাকলে তার অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। এজন্য মানবিক কারণে তাকে জামিন দিলে স্বাভাবিক পরিবেশে সুচিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মেডিকেল রিপোর্টে যা উল্লেখ আছে

২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর তার মানসিক অবস্থার বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আসামি মাহফুজা মালেক জেসমিন ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর হতে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভর্তি অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মানসিক অবস্থা পর্যালোচনার জন্য মেডিকেল বোর্ডে উপস্থাপনের পর রোগী ও তার নিকটাত্মীয় বোন ও স্বামীর কাছ থেকে বিস্তারিত ইতিহাস গ্রহণ, ওয়ার্ড পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট পর্যালোচনা ও রোগীর বর্তমান মানসিক পরীক্ষাপূর্বক বোর্ড সদস্যগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে-

১. তিনি সচিজওয়াফেক্টিভ ডিসর্ডার নামক মানসিক রোগে ভুগছেন।

২. তার নিয়মিত চিকিৎসা ও ফলোআপ প্রয়োজন।‘

মামলার অভিযোগে যা আছে

২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রামপুরা থানাধীন বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর সাততলা বাড়ির চতুর্থ তলা থেকে ইশরাত জাহান অরণী (১২) ও তার ভাই আলভী আমানকে (৭) অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

রাত পৌনে ৮টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনার পর দুই শিশুর বাবা-মাসহ পরিবারের অনেকেই খাদ্যে বিষক্রিয়ায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন।

৩ মার্চ নিজের দুই সন্তানকে হত্যার অভিযোগ এনে জেসমিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার স্বামী আমানউল্লাহ। এ মামলায় মা জেসমিন পাঁচদিনের রিমান্ডে ছিলেন। তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দুই সন্তানকে হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।

১৪ জুন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লোকমান হেকিম হত্যার অভিযোগে একমাত্র আসামি করে মা জেসমিনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি মাহফুজা মালেক জেসমিন তার ছেলে-মেয়ে পড়ালেখায় প্রত্যাশা অনুযায়ী রেজাল্ট না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় দুই সন্তানকে হত্যা করেন।

প্রথমে তিনি তার মেয়ে নুসরাত জাহান অরণীকে গলায় হাত চেপে ধরে ও ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরবর্তীতে ছেলে আলভী আমানকে একই ওড়না দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় নাক ও মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top