তিন দিবসে ৬০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির প্রত্যাশা চাষীদের

ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালী। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, আন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ও পহেলা ফাল্গুন উপলক্ষে আর্থিকভাবে লাভবানের আশায় নারী পুরুষেরা মিলে ফুল বাগানে দিন রাত পরিশ্রম করছেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে যশোরের ফুল বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের আবাদ করা হয়েছে।

আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এবার গদখালীর চাষিরা ৬০ কোটি টাকার বেশি ফুলের বিকিকিনি করতে পারবেন বলে চাষিরা প্রত্যাশা করছেন। গত বছরও তারা এই সময়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বেশি ফুল বিক্রি করেছিলেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ, গাঁধা, রজনীগন্ধা, গ্ল্যাডিওলাসসহ নানা রঙের ফুল। চোখ ধাঁধানো এই সৌন্দর্য কেবল মানুষের হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তিই আনে না, ফুল চাষ সমৃদ্ধিও এনেছে অনেকের জীবনে। ফুলেল স্নিগ্ধতায় এখন ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের।

আর বসন্ত, ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে মুখিয়ে আছেন দেশের কোটি তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সীরা। প্রিয়জনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে ফুলই শ্রেষ্ঠ। মানুষের মনের খোরাক মেটাতে এখন দিনরাত পরিশ্রম করছেন যশোরের গদখালীর ফুলচাষীরা।

ফুলকে ফুটতে মানা করছেন তারা। মালির আকুতি, ‘হে গোলাপ তুমি ভালোবাসা দিবসের আগে ফুটিও না’। মালিকের এ আকুতি গোলাপ শুনুক আর নাই শুনুক, ওই দিনের আগে গোলাপ যেন ফুটে ঝরে না যায় সে জন্য ফুটন্ত কুঁড়িতে পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ ক্যাপ। এতে গোলাপের কুঁড়ি বড় হবে কিন্তু ফুল ফুটে পাঁপড়ি ঝরে পড়বে না। এভাবে একমাস পর্যন্ত গোলাপ গাছেই রাখা সম্ভব বলে জানান চাষিরা। ফলে ‘ফুল ফুটে ঝরে যায় দুনিয়ার রীতি’- এ প্রবাদও এখন আর কার্যকর নয়, ফুলও ফুটছে মানুষের ইচ্ছায়।

চাষিরা গোলাপের কুঁড়িতে পরিয়ে দিয়েছেন সাদা ক্যাপ। ফুল যেন ফোটে দেরি করে। আগামী ১৩, ১৪ ও ২১ ফেব্রুয়ারির বাজার ধরতেই তাদের এই আপ্রাণ চেষ্টা। ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের মোকলেসুর রহমান এবার ২ একর জমিতে গোলাপ ফুলের আবাদ করেছেন। ফুলের ফলন ভালো হয়েছে। ফুলক্ষেতে তিনি ক্যাপ ব্যবহার করছেন। সামনের তিনটি দিবসের বাজার ধরতে তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন। ২ দিন আগে ক্ষেতের ক্যাপ খুলে ফেলবেন। এসময় ফুল বাজার উপযোগী হবে। রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় সরকারিও বেসরকারি অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের ফুল ব্যবহার হওয়ায় তারা ব্যবসায় মার খাচ্ছেনা বলে জানান তিনি।

পানিসারা গ্রামের হারুন অর রশিদ জানান, তিনি ২ বিঘা জমিতে জারবেরার আবাদ করেছেন। নববর্ষে ফুল বিক্রি না হলেও এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান।

চলতি মাসে রয়েছে বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আগামী ১৩ ফেরুয়ারি পয়লা ফাল্গুন, বসন্তের প্রথম দিন। পরদিন ভালোবাসা দিবস। এ দুটি দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে মুখিয়ে আছে দেশের তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সীরা।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের বহু চাষি তাদের জমিতে ধান, পাটের চাষ বদলে সারাবছরই ফুল চাষ করছেন। তাদের উৎপাদিত রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল সারাদেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছে। বিশেষ করে বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবসে এসব ফুলের বিকল্প নেই। আর ২১ ফেরুয়ারিতে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেও রয়েছে এ ফুলের ব্যাপক চাহিদা। তাই বছরের এ তিনটি দিবসকে ঘিরেই হয় মূল বেচাকেনা।

পাটুয়াপাড়ার বাসিন্দা ফুলচাষি সাহিদা বেগম বলেন, ‘আমরা গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখি, যাতে ফুল একটু দেরি করে ফোটে। কেননা বসন্ত দিবস, ভালোবাসা দিবস আর ২১ ফেরুয়ারিতে যাতে ফুল বাজারে দেওয়া যায়। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় পাঁচ টাকার মতো। যদি ৮-১০ টাকা বিক্রি করা যায় তাহলে ভালো মুনাফা হবে।

ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, এবার আমি ১৫ বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা, ডাবল রজনীগন্ধা (ভুট্টা) ও হাইব্রিড রজনীগন্ধা (উজ্জ্বল), গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা এবং গ্লাডিওলাস চাষ করেছি। ইংরেজি নববর্ষে ব্যবসা হয়নি। কিন্তু বসন্ত উৎসব, ভালোবাসা দিবস এবং মহান শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে ৫ লাখ টাকার ফুল বিক্রির আশা করছি।

জারবেরা ফুল চাষী নূর ইসলাম বলেন, এখন প্রতি সপ্তায় ৬-৭ হাজার পিস ফুল বিক্রি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মাসের তিন উৎসবকে সামনে রেখে কমপক্ষে ৭ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ারস সোসাইটির সভাপতি ও গদখালি ফুল চাষি কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এরমধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ৫-৬ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন।
সারাবছর টুকটাক ফুল বিক্রি হলেও মূলত তিনটি দিবসকে সামনে জোরেশোরে এখানকার চাষিরা ফুল চাষ করে থাকেন। গতবার(২০১৮) এই তিনটি দিবসকে সামনে রেখে চাষিরা ৪০ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করেছিল। এবার ফুলের দাম বাড়ার কারণে ৬০ কোটি টাকা বিক্রি ছাড়িয়ে যাবে।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচালক জানান, জেলায় ৬৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। আবহাওয়া অনুুকূলে থাকায় ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগই যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। এখানকার ফুল বিদেশেও রপ্তানী করা হয়।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top