জুমার দিনে মসজিদেই মৃত্যুর প্রত্যাশা ছিল তার

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছে ৫০ জন মুসুল্লি। এক শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী এই হত্যাকাণ্ড চালায়। প্রথমে সে আল নুর মসজিদে হামলা চালিয়ে এরপর পর লিনউড মসজিদে।

সেদিন আল নুর মসজিদের প্রবেশ পথে দাড়িয়ে ছিলেন ৭১ বছর বয়সী মুসুল্লি হাজী মোহাম্মদ দাউদ নবী। মসজিদে আগত সকল মুসুল্লিকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন তিনি। মসজিদে ঘাতককে প্রবেশ করতে দেখেও ভেবেছিলেন কোন মুসুল্লি জুমার নামাজ পড়তে এসেছেন। দাউদ ‘হ্যালো ব্রাদার’ বলে তাকে স্বাগত জানান। কিন্তু সাথে সাথে ঘাতকের হাতে বন্দুক তাক করতে দেখে হয়তো তার ভুল ভেঙেছিল; কিন্তু কিছু করার অবকাশ পাননি তিনি। ঘাতকের সেমি অটোমেটিক রাইফেলের বুলেট স্তব্ধ করে দেয় তার কণ্ঠস্বর।  দাউদের শরীরে তিনটি বুলেট পাওয়া গেছে পোস্ট মর্টেমের সময়।

ফেসবুক লাইভে যুক্ত হয়ে সেই দৃশ্য সম্প্রচার করতে করতে এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে খুনি ট্যারেন্ট। যার ফলে নৃশংস সেই দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী। সেই ভিডিওর একেবারে শুরুতেই দেখা যায় ট্যারেন্ট মসজিদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ভেতর থেকে একজন তার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হ্যালো ব্রাদার’। কিন্তু সে যে মুসুল্লি ছিলেন না সেটি বুঝতে পারেন যখন ততক্ষণে তার বুক ঝাঝড়া হয়ে গেছে গুলিতে।

তবে তারপরও সর্বশক্তি দিয়ে হামলারকারীকে মসজিদে প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছেন তিনি। তবে ভারী অস্ত্রর সাথে গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারেননি।

সেই হত্যাকাণ্ডের দিন হতাহতদের মধ্যে সর্বপ্রথম যাকে শনাক্ত করা হয়েছে তিনি দাউদ নবী। তার জন্ম আফগানিস্তানে। ১৯৮০ সালে সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে পালাতে পরিবার নিয়ে নিউজিল্যান্ডে চলে আসেন। তিনি পেশায় একজন প্রকৌশলী ছিলেন।অবসরের পর নিউজিল্যান্ডে একজন কমিউনিটি নেতা হয়ে ওঠেন। ইবাদত বন্দেগী আর সামাজিক কাযক্রম নিয়েই থাকতেন। স্থানীয় আফগান অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং অভিবাসীদের পরিচিত একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। স্থানীয় একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তার উদ্যোগ ছিলো অপরিসীম।

তার ছেলে ওমর নবী জানান, উদ্বাস্তুর আসছে এমন খবর পেলেই তাদের স্বাগত জানাতে দাউদ নবী এয়ারপোর্টে চলে যেতেন। ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া যেখান থেকেই আসুক না কেন, তিনি সবার আগে হাত বাড়িয়ে তাদের স্বাগত জানাতেন।  এবং ক্রাইস্টচার্চে তাদের নতুন জীবন শুরু করার বিষয়ে সব ধরনের সহযোগিতা করতেন।

ওমর নবী বলেন, তারা বাবা প্রায়ই বলতেন, শুক্রবার জুমার সময়ের মসজিদ হচ্ছে মৃত্যুর জন্য উত্তম জায়গা।

সহিংসতা থেকে বাঁচতে নিরাপদ জীবন যাপন করতে দেশ ছেড়েছিলেন দাউদ, কিন্তু সেই সহিংসতাই তার জীবন কেড়ে নিল বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ দেশটিতে। নিউজিল্যান্ডকে তিনি ‘এক খণ্ড বেহেশত’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন।

তার আরেক ছেলে ইয়ামা নবী বলেন, সেদিন মসজিদে যেতে তার কিছুটা দেরী হয় যে কারণেই্ হয়তো প্রাণে বেঁচে যান। তিনি যখন গাড়ি পার্ক করে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন তখন দেখতে পান আহত লোকরা বের হয়ে আসছেন।

এদিকে খুনির উদ্দেশ্যে বলা দাউদের শেষ দুটি বাক্য ‘হ্যালো ব্রাদার’ বা ‘হে ভাই’ সামাজিক যোগােযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাই ভাইরাল হয়েছে। অনেকেই এই বীরের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এই দুটি বাক্য ব্যবহার করছেন। অনেকেই বলছেন, ইসলাম এমনই মহত এক জীবনব্যবস্থা যেখানে খুনিকেও ভাই বলে সম্মোধন জানানো হয়। টুইটারে ইংরেজী, আরবি, পশতুনসহ অনেক ভাষাই এই বাক্য দুটি হাজার হাজার বার ব্যবহৃত হচ্ছে।

একজন লিখেছেন,  একটি পবিত্র আত্মার শেষ দুটি বাক্যও ছিলো শান্তির বার্তাযুক্ত ‘হ্যালো ব্রাদার’।

সূত্র: নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড ও বিবিসি

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top