জানালা দিয়ে লাফ দেয়ার অনুমতি দেননি ভাই-বাবা, পুড়ে কয়লা ফজলে রাব্বি

ঘটনার দিন দুপুর ১২টা থেকে কয়েকবার বাড়িতে ফোন করে কথা বলেন ফজলে রাব্বি। দুপুর ১ টা ৫৩ মিনিটে শেষ কথা হয় ছোট ভাই ও বাবা সাথে। অগ্নিকান্ডে আক্রান্ত বনানী এফ আর টাওয়ার থেকে রাব্বি তাদের জানিয়েছিলেন অফিস ফ্লোরে আচ্ছন্ন ধোঁয়ায় আটকা পড়ে গেছেন তিনি। বাঁচার জন্য জানালা দিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়বেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন ছোট ভাই ও বাবার কাছে। কিন্ত তারা ফজলে রাব্বিকে বারাবার নিষেধ করেছিলেন। তাদের কথা লাফিয়ে পড়েনি ঠিকই কিন্তু আগুনে পুড়ে মারা গেছেন রাব্বি।

স্বজনরা তখনো জানে না রাব্বির সর্বশেষ পরিনতি কী হয়েছে? ফোন দেয়ার পর বারবার মোবাইল বেজেই যাচ্ছিল কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। অবশেষে রাত ১০ টার দিকে কয়েকবার ফোন দেন তার বড় বোন শাম্মী আক্তার। কয়েকবার সেটি বেজে উঠার পর রিসিভ হয়। রিসিভ করেন রাব্বির মরদেহের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের একজন কর্মী। তিনি কথা বলেন ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা রাব্বির বোন শাম্মি আক্তারের সাথে। নিহত রাব্বির বাবা জহিরুল হক শুক্রবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ভুইগড় এলাকায় নয়াদিগন্তকে এসব তথ্য জানান।

বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ফজলে রাব্বির লাশ শনাক্তের পর শুক্রবার ভোর রাত চারটার দিকে ভূঁইগড় এলাকার বাড়িতে নিয়ে আসেন স্বজনরা। এরপর থেকে রাব্বিকে শেষবারের মতো দেখতে নবীনগর ভিলায় ছুটে আসতে শুরু করেন এলাকাবাসীসহ নিকট আত্মীয়-স্বজনরা। শুক্রবার জুমার নামাজের পর জানাযা শেষে রাব্বি পৈত্রিক নিবাস ব্রাক্ষনবাড়িয়া নবীনগর থানার সাতমোড়া গ্রামে দাফন করা হয়।

এদিকে অগ্নিকান্ডে নিহত সোনারগাঁও উপজেলার শম্ভুপুরার ইউনিয়নের নবীনগর এলাকায় আহমেদ জাফরের বাড়িতে শোকের মাতম চলছে। নিহত জাফরকে দাফন করা হয় সোনারগায়ের পারিবারিক কবরস্থানে।

নিহত ফজলে রাব্বির বাবা জহিরুল হক জানান,বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১২ তলায় ফ্লোগাল লজিস্টিস (ইউরো সার্ভিস) নামের একটি ফ্রেইড ফরোয়ার্ডিং কোম্পানিতে কাস্টিমার সার্ভিস এন্ড ডকুমেন্টেশন বিভাগে এক্সিকিউটিভ পদে কাজ করতেন ফজলে রাব্বি। গত এক বছর আগে এখানে কাজে যোগদান করেন তিনি।

পরিবারের মূল উপার্জনকারী বড় সন্তানের এই করুণ মৃত্যুকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না বৃদ্ধ বাবা জহিরুল হক। কান্নায় একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি। নিজে নিম্ন পর্যায়ের ছোটখাটো একটি চাকরি করলেও পুরো সংসারটাই চলতো বড় ছেলে রাব্বির উপার্জনের টাকা দিয়ে।

এ অবস্থায় একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে কিভাবে সংসার চলবে সেই দু:শ্চিন্তায় ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন বাবা জহিরুল হক। একই সাথে শোকে পাথর হয়ে গেছেন মা শাহনাজ বেগম স্ত্রী সাবিয়া বেগম ও একমাত্র ছোট বোন শাম্মি আক্তার। ছেলের ঝলসে যাওয়া নিথর দেহটির কথা বারাবার মনে করে বিলাপ করছেন স্বজনরা।

নিহতের মা শাহনাজ বেগম জানান, সকালে নাস্তা করে মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে অফিসে চলে যান রাব্বি। দুপুর বারোটায় তিনি ফোন করে অফিস ভবনে আগুনের কথা জানালে চিন্তিত ও আতংকিত হয়ে পড়েন তিনি। বারবার ছেলের খবর নিতে তাগাদা দিচ্ছিলেন স্বামী, ছোট ছেলে ও মেয়েকে। শেষমেষ রাত বারোটায় জানতে পারেন ছেলে আর নেই। ভোরে ছেলের ঝলসে যাওয়া নিথর মৃতদেহ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর থেকে প্রায় বাকশূণ্য হয়ে পড়েছেন তিনি।

এদিকে স্বামীকে লাশ হয়ে ফিরে আসতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রাব্বির স্ত্রী সাবিয়া। দুই বছরের সন্তানকে কিভাবে মানুষ করবেন ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছেন না। সরকারের কাছে তার দাবী, শিশু সনতানটিকে মানুষ করার ব্যাপারে যেন সহায়তা করা হয়। রাব্বির বৃদ্ধা শাশুড়িও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন স্বামীহারা মেয়ের বেদনায়। ক্রমাগত বিলাপ করছিলেন তিনি।

এদিকে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত অপর ব্যক্তির নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার আহমেদ জাফরের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে একই সময়ে। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে লাশ শনাক্ত করার পর স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে আসেন। আহমেদ জাফর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের শম্ভুপুরা ইউনিয়নের নবীনগর এলকার হেলাল উদ্দিনের ছেলে।

তার ভাতিজা আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, আহমেদ জাফর ছিলেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মাত্র তিন মাস আগে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করে বনানীর এফ আর টাওয়ারের আসিফ এন্টারপ্রাইজের ট্রান্সপোর্ট বিভাগের প্রধান পদে যোগদান করেছিলেন তিনি। বর্তমানে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হাউজিংয়ে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top