কোথায় গেলেন বাগদাদি? রহস্যে ঘুরপাঁক সারা দুনিয়ায়

ইরাক সীমান্ত লাগোয়া সিরিয়ার বাগহুজ শহরে উগ্রবাদীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের ‘খিলাফত’-এর শেষ ঠিকানাও মুছে গেছে দিন কয়েক আগে। মাস কয়েক ধরেই এই শহরে শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেছিল আইএস সদস্যরা। আমেরিকার সমর্থনে সিরিয়ার আসাদবিরোধী এসডিএফ (সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স) এই শহর দখল করার পর দুনিয়াজুড়ে বহুল আলোচিত আইএসের খিলাফতের অবসান ঘটে গত ২৩ মার্চ। ঘটা করে তা বিশ্বকে জানিয়ে দেয় হোয়াইট হাউস। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে চার বছর। আইএস নিকেশের নামে ইরাক ও সিরিয়ায় প্রায় ৩২ হাজার বার বিমান আক্রমণ হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে বহু শহর ও জনপদ। আবর দুনিয়ার প্রায় সব দেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় বাগহুজ অভিযানের লাইভ কভারেজ চলছে এখন। ইউটিউবে ধ্বংসাবশেষের ভিডিও চিত্রও মিলছে। ৪০০ থেকে ৫০০ আইএস উগ্রবাদী পরিবারসহ আত্মসমর্পণ বা মৃত্যুর অপেক্ষায়। এই বিজয়ের পরও একটাই প্রশ্ন, ‘খলিফা’ বাগদাদি কোথায়? কেউ জানে না তার ঠিকানা।

একটা গোটা দেশ ধ্বংস হয়ে গেলেও এখনো মেলেনি খেলাফতের ‘আমির’ আল-বাগদাদির সন্ধান। ৪৬ বছর বয়সী, সাদ্দাম ইউনিভার্সিটির এককালের পিএইচডিধারী বাগদাদি নিখোঁজ। এখনো গোটা দুনিয়ার হাতে তার একটা মাত্র ছবি। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে মসুলের আল-নুরি মসজিদে নিজেকে ‘খলিফা’ হিসেবে ঘোষণার সময় তোলা। ২০১৪ সালে আইএস যখন ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করে, তখন তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা। পশ্চিম সিরিয়া থেকে পূর্ব ইরাক পর্যন্ত বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে আরব দুনিয়ার শাসকদের ভীতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন তারা। ইরাকের মসুলকে রাজধানী ঘোষণা করে পরিচালিত সেই খিলাফতে প্রায় ৮০ লাখ স্থানীয় মানুষকে রাতারাতি বাগদাদিকে খলিফা মানতে হয়। এই স্থানীয়দের কাছে ‘খলিফা’ একসময় পরিচিত ছিলেন পারিবারিক নাম ইব্রাহিম আল-ভাদ্রি নামে। ২০১৮ সালের শুরুতে ইরাক সরকার তাদের দেশকে আইএসমুক্ত ঘোষণা করে। ধারণা করা হয়, মসুলের পতনের পর বাগদাদি এসে আশ্রয় নেন সিরিয়ার দেইর-আল-জউর শহরে। ইরাকের গোয়েন্দা মহলে এরকম কথা প্রচলিত রয়েছে যে বাগদাদি কখনো এক জায়গায় এক দিনের বেশি থাকেন না। অল্প কয়েকজন সহযোগীসহ চলাফেরা করেন তিনি। যারা কখনো নজরদারিযোগ্য ইলেকট্রনিক কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে না।

২০১৮ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে হোমস শহরে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ছোড়া রুশ মিসাইলে বাগদাদির ছেলে হুতাইফা আল-ভাদ্রি মারা যান। রুশরা একসময় বাগদাদিকে হত্যারও দাবি করেছিল। গত বছর আগস্টে তার ৫৫ মিনিটের এক ভিডিও ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর এই দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়। এটা ছিল প্রায় ১০ মাস পর বাগদাদির বেঁচে থাকার একমাত্র প্রমাণ। ইতিমধ্যে গত প্রায় সাত মাসে আইএস সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে বাগহুজে এসে থেমেছিল। এসডিএফ বাহিনীর লাগাতার হানায় সেই বাগহুজও ভেঙে পড়ে। কিন্তু বাগদাদির আর খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে ইফ্রেতিস নদীর তীর ঘেঁষে সর্বশেষ বেঁচে থাকা সহযোদ্ধাদের মধ্যেই রয়েছেন তিনি।

বাগহুজে আইএসের সবচেয়ে নেতৃস্থানীয় এসব সংগঠকের সামনে এখন আত্মসমর্পণ বা মৃত্যু অপেক্ষা করছে। এদের মধ্যেই বাগদাদির থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যুদ্ধের শেষ লগ্নেও বাগদাদিকে না পাওয়ায় তার অস্তিত্ব নিয়ে রহস্য বাড়ছে ক্রমে।

বাগহুজ সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় বাগদাদির পক্ষে ইরাকে ঢুকে পড়াও সম্ভব। আবার গত সেপ্টেম্বরে লন্ডনের একটি আরবি ভাষার সংবাদপত্র আশরাক আল-আওসাত লিখেছিল, ইরানের জাহিদান শহরের ভিতর দিয়ে বাগদাদি আফগানিস্তানের নানগাহরে চলে গেছেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের সূত্রে আশরাক আল-আওসাত এই প্রতিবেদন ছাপে। কিন্তু এই সংবাদের কোনো ভিত্তি মেলেনি। তবে আফগানিস্তান নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা। বাগদাদি আলজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বের তামানরাসেতে পৌঁছেছেন বলেও একটা সংবাদ রটেছিল গত বছর। তার আহত হওয়ারও বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। এসবই হয়তো আইএস উগ্রবাদীদের মনোবলে চিড় ধরাতে যুদ্ধের কৌশল ছিল। আইএসের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই আপসহীনভাবে যুদ্ধ করছে কুর্দিরা। কুর্দি গোয়েন্দাপ্রধান লাহুর তালাবানির অনুমানকে তাই এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই হয়। তার ভাষায়, ‘আমি ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত, বাগদাদি জীবিত। কিন্তু কেউই জানে না, তিনি এখন দেখতে কেমন, কোথায় আছেন!’ ২০১৬ সালে প্রধান সহযোগী মোহম্মদ আল-আদনানিকে হারানোর পর বাগদাদি নিজেকে আরো বেশি গোপনীয়তায় মুড়িয়ে নিয়েছে।

আইএস বিশেষজ্ঞ আমেরিকার সাংবাদিক জবি উরিকের নেতৃত্বে ওয়াশিংটন পোস্টে লেখেন, খিলাফতের পতন অনিবার্য জেনে বাগদাদি গত বছর থেকে পুরো সংগঠনে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে শুরু করেন। আইএসকে ক্রমে গেরিলা সংগঠনে পরিণত করার কাজ সম্পন্ন হয়। কৌশলগত এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল ‘খিলাফতের পতন’ শেষেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরবর্তী প্রজন্মের উপর প্রভাব ধরে রাখা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে বাগদাদি প্রচারমাধ্যমে কম হাজির হতে থাকেন। সংগঠনটিকে ঘিরে রহস্যের কালো মেঘ আর গাঢ় হয় মাত্র।

গবেষক আলতাফ পারভেজ উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখেছেন, বাগহুজের পতনকে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম ও আমেরিকা তাদের বড় এক সামরিক সাফল্য হিসেবে দেখালেও এটা সত্য যে এই উগ্রবাদীরা আরব দুনিয়ার দেশে দেশে সন্ত্রাসবাদী কাজ করে চলবে। বাগদাদি অধরা থাকা পর্যন্ত তাদের মনোবলেও চিড় ধরার সম্ভাবনা কম। সিরিয়ায় কুর্দিদের হাতে স্ত্রী-পরিজনসহ ইতিমধ্যে আটক কয়েক শ’ বিদেশি আইএস উগ্রবাদী প্রমাণ করছে, বাগদাদির বিশ্ব নেটওয়ার্ক অনেক বড় ও ব্যাপক। বাগহুজের পতন আইএসের অভ্যন্তর থেকেই নতুন কোনো নেতার মাধ্যমে নতুন ধারার সংগঠনের জন্ম দিতে পারেন। আইএস উগ্রবাদীদের একাংশ ধীরে ধীরে পুরোনো সংগঠন আল-কায়েদায়ও শামিল হতে পারে। ফলে, বাগহুজের পতন এবং বাগদাদির খোঁজ না পাওয়ায়, আইএসবিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার পরিবর্তে আরো জটিল ও বিপজ্জনক এক অধ্যায়ে ঢুকল মাত্র।

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top