উইঘুরদের নিয়ে ভাবতে হবে

চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বাইরের জগতে কমই গুরুত্ব পায়। চীনের খবরাখবর সরকারনিয়ন্ত্রিত ‘সিনহুয়া’ এবং কয়েকটি সংবাদপত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বহির্বিশ্বে পরিবেশিত হয়। তারপরও চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের খবর বিশ্ব মিডিয়ায় আসছে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বন্দিশিবিরে ১০ লক্ষাধিক উইঘুর মুসলিমকে আটকে রাখার তীব্র নিন্দা জানিয়ে এগুলো বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে- চীনের এসব বন্দিশিবির মানবতার জন্য ভয়াবহ লজ্জাজনক। বন্দিশিবিরে আট বছর ধরে আটক থাকা জনপ্রিয় সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী আবদুর রহিম হায়াতের মৃত্যুর খবর প্রকাশের পর এ আহ্বান জানায়।

১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক রাখার খবর নতুন নয়। গত বছর আগস্টের শেষ দিকে এ বিষয় উত্থাপন করেছে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিটি। উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল ওই কমিটি। জাতিসঙ্ঘের জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ কমিটি দাবি করে, উইঘুরদের গণহারে আটক রাখার ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্য’ তাদের কাছে আছে।
চীন এখন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ এবং সামরিকভাবে তৃতীয় পরাশক্তি। তা ছাড়া, চীন দেশে দেশে সবচেয়ে বড় অর্থ বিনিয়োগকারী দেশও।

চীন এখন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ নামে এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে ৬৮টি দেশকে নিবিড় যোগাযোগের বন্ধনে আবদ্ধ করার মহাপরিকল্পনায় এগিয়ে যাচ্ছে। তাই চীনের ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে মাথা ঘামানোর লোকের অভাব আছে। তবে উইঘুরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান।

উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হাসি আকসয় বলেন, চীনের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ নির্যাতনের মাধ্যমে বন্দীদের মগজ ধোলাই করা হয়। মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে বন্দিশিবির বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে তুরস্ক। নিপীড়ন কেন্দ্র ও কারাগারগুলোকে নির্যাতন ও মগজ ধোলাইয়ের লক্ষ্যে পরিণত করা হয়েছে। তিনি বলেন, চীনা কর্তৃপক্ষকে আমরা উইঘুর তুর্কিদের মৌলিক মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের আহ্বান জানাই। একুশ শতাব্দীতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের পুনঃপ্রবর্তন এবং উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের সুপরিকল্পিত ‘আত্তীকরণ’ নীতি মানবতার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। তিনি বলেন, শিল্পী হায়াতের মৃত্যুতে জিনজিয়াংয়ে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তুরস্কের জনগণের প্রতিক্রিয়া আরো তীব্র হয়েছে।

এক সময় পুরো চীনের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন সুরকার ও লোকশিল্পী হায়াত। তিনি বেইজিংয়ে মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং জাতীয় শিল্পীদলগুলোর সাথে বাজনা বাজাতেন। উইঘুর তরুণদের উজ্জীবিত ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে একটি গান গাওয়ার কারণে হায়াতকে আটক করা হয়েছিল। দীর্ঘ আট বছর বন্দিশিবিরে আটক থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এ দিকে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে বেইজিং। হায়াতের মৃত্যুর বিষয়টিও অস্বীকার করেছেন তারা। তুরস্কে চীনা কূটনৈতিক মিশন জানায়, ‘৫৭ বছর বয়সী শিল্পী আবদুর রহিম হায়াত আট বছর বন্দিশিবিরে থাকাবস্থায় মারা গেছেন, এই খবর মিথ্যা।’

রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত চীনা বেতারে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২৫ সেকেন্ডের বিমর্ষ চেহারার হায়াতের একটি ভিডিও সম্প্রচার করা হয়। সেই ভিডিওতে বলা হয়- I am in good health and have been never abused.
ভিডিওটিকে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র দাবি করেন, হায়াত ‘জীবিত ও সুস্থ’ আছেন।

নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে, মধ্য এশিয়ার সীমান্ত-সংলগ্ন চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় সুবিশাল জিনজিয়াং প্রদেশে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপুল চীনা সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। বেইজিং বলছে, অঞ্চলটিতে উইঘুর সম্প্রদায়ের কিছু লোক ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী’ তৎপরতায় লিপ্ত। এদের দমন করতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানো হচ্ছে এবং কথিত উগ্রবাদীদের সংশোধন ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের সংখ্যা কত? জাতিসঙ্ঘের জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ কমিটি এবং তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি মোতাবেক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক বন্দী উইঘুরদের সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি। এ ব্যাপারে চীনা কর্তৃপক্ষ এখনো দ্বিমত পোষণ করেনি। ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার চীনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জাতিগোষ্ঠী ছাড়াও ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বাস করে। চীনে ধর্মও বেশ কয়েকটি। ১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর ধর্মকে ‘আফিম’তুল্য নিষিদ্ধ বিষয় হিসেবে গণ্য করা হলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মকে কিছুটা হলেও ধরে রেখেছেন। চীনে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বৌদ্ধ, তাও এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ছাড়াও ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ১০টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তারা হলেন- হুই, উইঘুর, কাজাখ, কিরগিজ, তাজিক, তাতার, উজবেক, তুংশিয়াং, সালার, পাওআন। চীনে মোট মুসলিম জনসংখ্যা দুই কোটি ৩২ লাখ (২০১২)। এ ১০টি সংখ্যালঘু জাতি প্রধানত উত্তর-পশ্চিম চীনের জিনজিয়াং, নিংশিয়া, সাংহাই, কানসু প্রভৃতি অঞ্চলে বেশি বাস করে। মোট জনসংখ্যার ১.৬৪ শতাংশ মুসলিম। আর চীনের ৫৮.২ শতাংশ মুসলিমের বাস জিনজিয়াং প্রদেশে (এক কোটি ১৩ লাখ ৩৫৫)। এ ছাড়া উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার ২২০ (২০০৮), তুরস্কে ৪৫ হাজার ৮০০ (২০১০) এবং রাশিয়ায় তিন হাজার ৬৯৫ (২০১০) উউঘুর আছে। আরো অনেক দেশেই এরা ছড়িয়ে গেছে।

চীনের স্বায়ত্তশাসিত জিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের বসবাস প্রাচীনকাল থেকে। এ ইতিহাস ১৩০০ বছরের। টাং রাজবংশের (৬১৮-৯০৭ খ্রি:) এবং সুং রাজবংশের (৯৬০-১২৭৯ খ্রি:) আমলে চীনের এ অঞ্চলেই ইসলাম ধর্মের প্রচলন হয়েছিল। আরব সওদাগরেরা চীনে আসতে শুরু করার সাথে সাথে আরো বেশি সংখ্যায় মুসলিম আশপাশের অঞ্চল থেকে আসতে থাকেন। তাদের অনেকে চীনেই বিয়ে করে বাস করতে শুরু করেন। জিনজিয়াংয়ের আদি বাসিন্দা হচ্ছেন উইঘুররা। তারা ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম ধর্ম ধরে রেখেছেন। আর এ জন্য ‘শাস্তি’ পেতে হচ্ছে নানাভাবে। নামাজ, রোজা, হিজাব কিংবা মাথায় স্কার্ফ পরিধান করতে দেখলেই সংশোধনের নামে পাঠানো হচ্ছে ক্যাম্পে।

চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এবং সরকারের নীতি প্রতিফলনকারী ইংরেজি পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ জানিয়েছে, সম্প্রতি চীনে নতুন আইন প্রণীত হয়েছে, যার দ্বারা পাঁচ বছরের মধ্যে ইসলামের অনুসারীদের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা চীনের রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব ও সমাজতন্ত্রের ভেতর আত্তীকরণ করা ওই আইনের আরেক লক্ষ্য। গ্লোবাল টাইমস বলছে- ‘The new law seeks to guide islam to be compitible with socialism.’ উল্লেখ্য, উইঘুর বা মুসলিম জাতিসত্তার ওপর চীন সরকারের দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। বিক্ষোভ মিছিল এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ ইত্যাদি চলছে। সে ক্ষেত্রে ক্যামেরায় ফুটেজে চিহ্নিত হওয়া ব্যক্তিদের আটক করা হচ্ছে।

অনেক দেশে সংখ্যালঘু মুসলিমরা নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। তার জ্বলন্ত প্রমাণ রোহিঙ্গারা। বিশ্বের ১৫৭ কোটির বেশি মুসলমানদের মধ্যে দেড় কোটি চীনা মুসলিম। এবার শিল্পী আবদুর রহিম হায়াতের মৃত্যু সংবাদে তুর্কি সরকারের প্রতিবাদ চীনা সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছে। তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে নিয়ে মুসলিম শক্তির মোর্চা গঠনে চীন যে প্রয়াস চালাচ্ছে তাকে সফল পরিণতির দিকে নিতে হলে উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে সহনশীল নীতি অবলম্বন করতে হবে। বিশ্বের মুসলিমদের ব্যাপারেও চীনা নীতি হতে হবে উদার ও সহিষ্ণু। চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিংকে এটি উপলব্ধি করতে হবে।
লেখক : কবি ও কথা সাহিত্যিক

Share this post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

scroll to top